জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে মতামত চেয়ে জুলাই জাতীয় সনদের যে পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সাথে আলোচনা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের পর তা নিয়ে লিখিত মতামত দিয়েছে বিএনপি।
বুধবার (২০ আগস্ট) সন্ধ্যায় ঐকমত্য কমিশনে সেটি জমা দিয়েছে দলটি। জানা গেছে, নির্বাচনের স্বার্থে যতটা ছাড় দেওয়া দরকার, মতামতে ততটা ছাড় দিয়েছে বিএনপি।
দলটির এখন প্রত্যাশা, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণীত ও বাস্তবায়িত হবে। তবে অঙ্গীকারনামায় থাকা কয়েকটি প্রস্তাবে দলীয় ভিন্নমত থাকলেও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এর আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যাবে বলে বিশ্বাস বিএনপির। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে বৈঠকের পরিকল্পনা করছে, সেখানে এ ব্যাপারে তাদের মতামত তুলে ধরবে দলটি।
এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে মিত্রদের অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ইতঃপূর্বে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া বিষয়গুলো সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় না আসলে সেটা উল্লেখপূর্বক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মতামত জমা দেওয়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছে। জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে গত দুদিনে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে তাদেরকে এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। শুক্রবার (২২ আগস্ট) বিকেল ৩টা পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনে দলগুলোর মতামত জমা দেওয়া যাবে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেয়। প্রথম ধাপে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। গত ২৯ জুলাই দলগুলোকে জুলাই সনদের একটি খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেটি নিয়ে দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় ‘সমন্বিত খসড়া’, যা গত শনিবার সন্ধ্যায় দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
এরপর গত সোমবার খসড়া নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে বিএনপি। সেখানে খসড়া পর্যালোচনা করে দলের বক্তব্য ঠিক করতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদসহ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন মঙ্গলবার প্রথমে যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চ এবং পরে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে বিএনপি।
এ ছাড়া বুধবার (২০ আগস্ট) ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির সঙ্গে বৈঠক করে দলটি। রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আট দফা অঙ্গীকারনামার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে বিএনপি। দল ও মিত্রদের অভিমত, রাজনৈতিক দলগুলো যখন এই সনদে স্বাক্ষর করবে, সেটিই মূলত অঙ্গীকার। এর বাইরে আলাদা করে আর অঙ্গীকারের প্রয়োজন নেই। তারপরও পৃথকভাবে অঙ্গীকারনামা রাখতে হলে সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে থাকতে হবে।
সনদের খসড়ায় অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, জনগণের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে- বিধায় এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করা হবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম, জেএসডির সিরাজ মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি ও জোটের নেতারা মনে করেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া সঠিক হবে না। কারণ, কোনো সমঝতা দলিল, ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। যদি এমনটা করা হয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে।
অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ বিষয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের অভিমত হচ্ছে, কোনো নাগরিক যদি তার জীবন, সম্পদ বা অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তার আইনি আশ্রয় লাভের অধিকার আছে, প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে। এ দিক দিয়ে এটি (প্রশ্ন না তোলার বিধান) ঠিক হবে না।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে বিভিন্ন এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলেছে। জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচনার একপর্যায়ে মঞ্চের নেতারা বলেন, জুলাই সনদের আইনি সুরক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের ভিত্তিতে শপথ নিয়েছে। জুলাই সনদের ক্ষেত্রেও সেটি অনুসরণ করা যেতে পারে। বিএনপির পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়, আগামীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে কোনো পক্ষ থেকে এমন মতামত বা পরামর্শ দেওয়া হলে বিএনপি তাতে আপত্তি জানাবে না।
জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে দলীয় মতামত ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালবেলাকে বলেন, আমাদের প্রত্যাশা- জুলাই জাতীয় সনদ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে এবং বাস্তবায়িত হবে। তবে অঙ্গীকারনামায় যে প্রস্তাবগুলো রাখা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝতার এই দলিলকে সংবিধানের ওপরে রাখা এবং কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না ইত্যাদি বিষয়গুলো গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্য আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যে কোনো আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণের পর জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে জোটের মতামত চূড়ান্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) তা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন