যশোরের বেশ কয়েকটি স্থানে সস্প্রতি পথের ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগলিদের মা হওয়ার ঘটনা আলোচনা এসেছে। সর্বশেষ বুধবার রাতে যশোরের চৌগাছায় পথের ভবঘুরে নারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। রাতেই ইউএনও ইরুফা সুলতানা ওই নারীর খোঁজখবর নিতে হাসপাতালে যান এবং নবজাতককে কোলে তুলে নেন।
এর আগে ১৮ নভেম্বর ইউএনওর নির্দেশে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার একটি গ্রাম থেকে অসুস্থ সন্তানসম্ভবা ওই নারীকে নিয়ে এসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে তার চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি ফলমূলও পাঠিয়েছিলেন ইউএনও।
গত সেপ্টেম্বর মাসে যশোরের বাঘারপাড়ায় পরিচয়হীন এক নারীর কোলজুড়ে এসেছিল জমজ ফুটফুটে এক ছেলে ও এক মেয়ে। পরে তাদের পাঠানো হয়েছিল খুলনার ছোটমনি নিবাসে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে খুলনার কপিলমুনিতে ভবঘুরে এক নারীর ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম দেয়। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। তবে একের পর এক জন্ম নেওয়া এসব শিশুর বাবা হচ্ছেন না কেউ। যার কারণে জন্মের দিন হতেই তাদের অভিভাবক হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা কিংবা দত্তক নেওয়া পরিবারটি। এইসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
চৌগাছা ইউএনও ইরুফা সুলতানা নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নবজাতক শিশুটির বাবার সন্ধান চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মানসিকভারসাম্যহীন ওই নারীকে বাচ্চাসহ সেইফ হোমে রাখা সম্ভব নয়, আবার মায়ের কোল খালি করে বাচ্চাকে অন্য কাউকে দেওয়াও সম্ভব নয়। একইভাবে ওই মায়ের ভরসায় বাচ্চাকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ফলে তার পরিবারের খোঁজ পাওয়া অতি জরুরি।’ সচেতন মহল ও মানবাধিকার কর্মকর্তারা মনে করেন, রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের মা হওয়ার ঘটনাকে সামাজিক অবক্ষয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তারা বলছেন, বর্তমান সময়ে মানুষ সচেতন হওয়া সত্বেও এ ধরনের ঘটনা দুঃখজনক। এসব মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের মা হওয়া বা গর্ভধারণ করার ঘটনাটি অত্যান্ত দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর। নতুন শিশু পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখুক এটা সবাই চায়, তবে এভাবে একটা শিশু পিতৃ পরিচয়হীন এবং অবৈধ গর্ভপাতের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসুক এটা আমরা চাই না।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় সামাজিকভাবে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর এসব ভবঘুরে মানিসক প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করলে এ ধরনের অবৈধ গর্ভপাত বন্ধ করা সম্ভব। নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রাইটস্ যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, আমাদের দেশের অনেক সংগঠন আছে যারা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে, তবে প্রয়োজনের সময় তাদের পাওয়া যায় না। এমনি সময় তারা একটা-দুইটা হুইল চেয়ার দিয়ে কাজ সেরে দেয়। কিছুদিন আগে বাঘারপাড়ার নবজাতক দুটিকে নিয়ে আমাদের অনেক ধকল পোহাতে হয়েছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। আমি মনে করি সরকারি উদ্যোগ এবং প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যারা কাজ করে তারা সকলে এগিয়ে আসলে এ ধরনের ব্যাধী সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব। সামাজিক বৈকল্যতা বা অবক্ষয়ের কারণে বর্তমানে এ ধরণের ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে ভবঘুরে মানসিকতা ভারসাম্যহীন মায়েরা।
তবে এসব ভারসাম্যহীন মানুষদের জন্য যশোরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই বলে জানালেন যশোর জেলা প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিন। তিনি বলেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশু ও মায়ের সর্বশেষ ঠিকানা হচ্ছে শিশু আশ্রম ও মানসিক আশ্রয়কেন্দ্রে।
তিনি বলেন, যশোরে এ ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিরাপদে রাখার জন্য কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এটি ঢাকা বিভাগের মধ্যে আছে। এটি যশোরে থাকলে এসব মায়েদের রক্ষণাবেক্ষণ করা যেত।
তিনি আরও বলেন, এসব ভারসাম্যহীন মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের তার পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেলেও পরিবার নিতে চায় না, পরবর্তীতে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে দিতে হয়। অনেক সময় এমন নবজাতকদের দত্তক নেওয়ার জন্য অনেক নিঃসন্তান পিতা-মাতা ভিড় করে, শিশুকে নিয়ে যদি জটিলতা না তাকে তাহলে তাদে দেওয়া যেতে পারে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, এ ধরনের ঘটনার পেছনে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে সেক্ষেত্রে আমাদের নিকট অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরের ক্ষেত্রে কে বা কারা অভিযোগ দিতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে সমাজসেবা কর্মকর্তারা তাদের পক্ষ নিয়ে অভিযোগ দিতে পারে।
পথে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরে এসব মানসিক প্রতিবন্ধী নারীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা হবে এবং সমাজ থেকে এমন ব্যাধী দূর হবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।
মন্তব্য করুন