সূর্যের আলো ফোটার আগেই কুয়াকাটার সৈকতে হাজির হাজারো সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ। সোমবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাস উৎসবে আসা পুণ্যার্থীরা সূর্য দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে ও উলুধ্বনি দিয়ে সাগরে পুণ্যস্নানে নেমে পড়েন। এ সময় পুণ্যার্থীরা মোম ও আগরবাতি জ্বালিয়ে অর্ঘ্যদান করেন গঙ্গাদেবীকে। পরে ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কুয়াকাটায় শেষ হয় তিন দিনব্যাপী রাস উৎসব। এবারের রাস উৎসবে প্রায় অর্ধ লক্ষ পুণ্যার্থী, দর্শনার্থী ও পর্যটক এসেছিলেন কুয়াকাটায়।
গত রোববার কুয়াকাটায় রাস উৎসব শুরু হয়। রাস উৎসবকে ঘিরে পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের উপস্থিতিতে কুয়াকাটার ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত মুখর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া রাস মেলায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের জন্য।
পুণ্যার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে অবরোধের কারণে দূরপাল্লার বাস তেমন চলাচল না করায় পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের আগমন কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন আয়োজকেরা। তারপরও রাস উৎসব ও মেলায় যোগ দিতে গতকাল রোববার সকাল থেকে কুয়াকাটায় আসতে থাকেন মানুষ। মাঝরাতেও দেখা গেছে মানুষের আগমন। কুয়াকাটার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউসগুলোতেও ভিড় দেখা যায়। রাস উৎসবকে ঘিরে কুয়াকাটার ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকত পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আলোচনা সভাসহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখে পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের।
এর আগে রাস উৎসবকে ঘিরে গতকাল রাতে গতকাল রাতে কুয়াকাটায় শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও তীর্থযাত্রী সেবাশ্রম প্রাঙ্গণে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম এ উৎসবের উদ্বোধন করেন। মন্দির কমিটির সভাপতি বিপুল হালদারের সভাপতিত্বে এবং উৎসবের সমন্বয়ক কাজল বরণ দাসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, কুয়াকাটা পৌর মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার প্রমুখ।
রাস উৎসব উপলক্ষে সৈকতে বসেছিল তিন দিনব্যাপী মেলা। রকমারি পণ্যের পসরা ছিল এ মেলায়। গতকাল সারা রাতই মেলায় ভিড় ছিল। নড়াইলের মহাজন বাজার এলাকার মনির হাওলাদার ও বাপ্পী হাওলাদার এ মেলায় কাসা, পিতল, তামা দিয়ে তৈরি তৈজসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন। মনির হাওলাদার বলেন, এবারের বেচাকেনা ভালো হয়েছে। উৎসবে আসতে পেরে তিনিও খুশি। কারণ, যেকোনো উৎসব বা মেলার ওপরই তাঁদের জীবিকা নির্ভর করে। ঐতিহ্যবাহী এ রাস উৎসবকে ঘিরে কুয়াকাটার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসগুলো তিন দিন ধরে পরিপূর্ণ ছিল। এর বাইরেও অনেক মানুষ শামিয়ানা টানিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সংঘের আশ্রমে রাত কাটিয়েছেন।
কুয়াকাটা শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ তীর্থযাত্রী সেবাশ্রম মন্দিরের পুরোহিত গৌর চক্রবর্তী জানান, কয়েক শ বছর ধরে কুয়াকাটা হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। তখন থেকেই এখানে পুণ্যস্নান হয়ে আসছে। পুরানমতে, শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রা উৎসব উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা সাগরে পুণ্যস্নানে অংশ নেন পূর্ণিমায়। মাসব্যাপী শারদীয় কাত্যায়নী পূজা শেষে পূর্ণিমাতেই শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন। সেই থেকে এই উৎসব। ধর্মমতে, যেহেতু গঙ্গার জল সমুদ্রে মিশেছে, কাজেই পূর্ণিমার তিথিতে সাগরস্নানে অংশ নিলে পাপ মোচন হবে।
বরিশাল থেকে রাস উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন সুশান্ত কুমার সাহা। গতকাল সন্ধ্যায় সৈকতে বসে তিনি বলেন, ‘শত বছরের এই উৎসবে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের। অবরোধ চলছে, তারপরও বরিশাল থেকে বাস চলাচল কারায়। এবার আশা পূর্ণ করেছি।’ পটুয়াখালী বাউফল উপজেলার কালাইয়া বন্দর থেকে এসেছেন বিমল কর্মকার। তিনি বলেন, বড় উৎসব। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসছেন, তাই তিনিও এসেছেন পুণ্যস্নানে অংশ নিতে।
বরগুনা থেকে এসেছেন শহিদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার। গতকাল বিকেলে সৈকতে দাঁড়িয়ে সুমাইয়া বলেন, ‘সাগর আমাদের এত কাছে, তবু কখনো সাগর দেখা হয়নি। তাই এই রাস উৎসবে এসেছি। উৎসব ও সাগর একসঙ্গে দেখা হবে।’
এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও রাস উৎসব উপলক্ষে সৈকতে দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। জেলার গলাচিপা থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী রশিদ হাওলাদার। তিনি সৈকতে অস্থায়ী দোকানে চুড়ি, কানের দুল, মালা, আলতা, ফিতা নিয়ে বসেছেন। তিনি জানান, এবার অবরোধের কারণে দূরদূরান্তের লোকজন কম এসেছেন। তাই লোকসমাগমও কম। গত বছরের তুলনায় বেচাবিক্রিও একটু কম।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মোতালেব শরীফ বলেন, বছরের এমন দিনের জন্যই তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন। রাস উৎসবকে ঘিরে প্রতিবছরই পুণ্যার্থী, ভক্তদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। তবে এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় দূরপাল্লার বাস বন্ধ। এ কারণে লোকসমাগম কম।
কুয়াকাটায় শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও তীর্থযাত্রী সেবাশ্রম কমিটির সভাপতি বিপুল হালদার বলেন, হরতাল-অবরোধের পরও হাজারো মানুষের পদচারণে গোটা সৈকত এলাকা মুখরিত হয়ে উঠেছে। এখানকার পরিস্থিত ভালো। তাই পর্যটক আর দর্শনার্থীর হইহুল্লোড়ে কুয়াকাটায় অনেকটা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনসহ সবার সহযোগিতা পাওয়ায় এ উৎসব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে।
মন্তব্য করুন