‘আমার মেয়ের মাথা অল্পের জন্য কাটা পড়েনি, তবে আঘাত পেয়েছে। চিকিৎসকরা সিটিস্ক্যান করতে বলছেন। এখন সঙ্গে টাকা-পয়সা নেই, বাড়িতে খবর দিয়েছি। সিটিস্ক্যান হলে মেয়ের অবস্থা জানা যাবে’। গাজীপুরের ভাওয়ালের কাছে বনখড়িয়া এলাকায় দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে আহত সুরভী আক্তারের মা এভাবেই মেয়ের অবস্থার বর্ণনা দেন।
আজ বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ভোর সোয়া ৪টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের বনখড়িয়া এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি নেত্রকোনা থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা নাশকতা করতে রেললাইনের অংশ কেটে রাখে। দুর্ঘটনায় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রওহা গ্রামের আসলাম হোসেন (৪২) নামের এক যাত্রী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
নিহত আসলাম (৪২) ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার রৌহা সাইটা এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে। এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে ১১ জনকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৭ম তলায় মেঝেতে অঝোরে কাঁদছেন কুমিল্লার হাটখোলা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী সুরভী আক্তার। ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পর মাথায় আঘাত পাওয়া সুরভীকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর এ দুর্ঘটনার কারণে এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে গেল বলে কাঁদছেন এই শিক্ষার্থী।
সুরভী আক্তার বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যায়। আমি মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছি। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। অসুস্থ থাকলে কীভাবে পরীক্ষা দেব।
আহত ওই শিক্ষার্থী সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে নেত্রকোনা থেকে কুমিল্লায় ফিরছিলেন তার মা। দুর্ঘটনায় মেয়ে আঘাত পেয়ে শয্যাশায়ী হওয়ায় ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত মা।
স্থানীয়রা জানায়, বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি গাজীপুরের বনখড়িয়া এলাকার ছিলাই বিলের পাশে দুর্বৃত্তদের কেটে রাখা রেললাইনের অংশে গেলে ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে ট্রেনের সাতটি বগি বিকট শব্দে লাইনচ্যুত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যায়। এ সময় আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে পুলিশে খবর দেন। খবর পেয়ে রেলওয়ে পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতার কাজ শুরু করেন।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন জানান, নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাওয়াল স্টেশনের এক কিলোমিটার উত্তরে বনখড়িয়া এলাকায় প্রবেশের সময় ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৭টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ট্রেনের যাত্রী আসলাম নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার পর বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ রুটের রেল যোগাযোগ। বিভিন্ন স্টেশনে কয়েকটি ট্রেন আটকা পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। দুর্ঘটনার পর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, নাশকতা সৃষ্টিকারীরা রেললাইনের অন্তত ২০ ফুট কেটে নেওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে এক যাত্রী নিহত হয়েছেন।
গাজীপুর পুলিশ সুপার সফিকুল ইসলাম বলেন, নাশকতাকারীরা রেললাইন কেটে ফেলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। জড়িতদের শনাক্তসহ তাদের গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কাজ করছে।
তদন্ত কমিটি গঠন:
ঘটনা তদন্তে রেলওয়ে ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি কমিটি করা হয়েছে। রেলের ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিভাগীয় প্রকৌশলী (সংকেত ও টেলিযোগাযোগ) সৌমিক শাওন কবিরকে।
রেলওয়ে কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ঘটনাটি দুর্বৃত্তরা নাশকতা ঘটানোর জন্য করেছে। তারপরও সঠিক কারণ অনুসন্ধানে বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সৌমিক শাওন কবিরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভাগীয় পরিবহন প্রকৌশলী, বিভাগীয় যাত্রী প্রকৌশলী, বিভাগীয় চিকিৎসকও আছেন এই কমিটিতে।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করার কথা জানিয়েছেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম। দুটি কমিটিকেই তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন