বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খুলনা জেলার সর্ব দক্ষিণের জনপদ উপকূলীয় অঞ্চল কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততা। ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। সুপেয় পানির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন সময় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এদিকে দিন যত গড়াচ্ছে কয়রা উপজেলার বিভিন্ন নদনদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ ততই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন উল্লেখযোগ্য। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর পরপরই বড় ধরনের দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। ভূতাত্ত্বিকভাবে দেশটি থেকে উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল। যেখান থেকে বরফগলা পানির প্রবাহে সৃষ্ট বড় বড় নদী দেশের ভেতর দিয়ে প্রবহমাণ এবং নদীগুলো গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। বর্ষাকালে নদীবাহিত পানির প্রবাহ বেড়ে নদী উপচে পানি লোকালয়ে পৌঁছে যায় এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় ও অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্র থেকে আসা লোনা পানি জেলার কয়রা উপজেলার নিম্নভূমিতে ঢুকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে ভেঙে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো, বেড়িবাঁধ। ফলে অবাধে লোনা পানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দেয়। অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে লবণ পানি প্রবেশের ফলে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেখা দেয় সুপেয় পানিরও মারাত্মক অভাব। মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় উপকূলের বাসিন্দারা। অতিরিক্ত লবণ পানির প্রভাবে বিভিন্ন গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে অনেক কৃষক কৃষি কাজে অনীহা দেখাচ্ছে। প্রতি বছর পাইকগাছা-কয়রা এই দুটি উপজেলার উপকূলীয় এলাকার উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে গেলে, বৃষ্টিতে সেই লবণাক্ততা কাটাতে প্রায় দুই তিন বছর সময় লাগে। কিন্তু লবণাক্ততা কাটতে না কাটতেই আবার প্লাবিত হয় এলাকা।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০ ও ২০০১ সালে ঘূর্ণিঝড় হলেও তা তেমন ক্ষয়ক্ষতি করেনি। এ ছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোনো ঘূর্ণিঝড়ই হয়নি। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে এসব জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা, তেমনি বেড়েছে এদের সংখ্যা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে সিডর, তার প্রভাব রেখে যেতে না যেতেই পিছু পিছু ২০০৮ সালের ২ মে ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, একই বছর ২৬ অক্টোবর রেশমি, ১৫ নভেম্বর খাইমুক, ২৬ নভেম্বর নিসা, ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিজলি এবং একই বছর ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা। এরপর মহাসেন, তিতলি, ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান ও ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবরে আঘাত হানে সিত্রাং এবং শেষ মিথধিলির আঘাত। এসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পাইকগাছা-কয়রা উপজেলার বির্ভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসময় সমুদ্রের লোনাপানি বিভিন্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়সহ ফসলের মাঠে প্রবেশ করে এবং স্বাদু পানিকে লোনা করে দেয়।
কয়রা উপজেলার কাটকাটা গ্রামের দিনেশ মন্ডল জানান, অতিরিক্ত লবণ পানির ফলে এলাকায় কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসলের জমিতে লবণ পানি ঢুকে পড়ে। বেশি লবণাক্ততার ফলে ফসলের বৃদ্ধি এবং উৎপাদনও কম হয়। মঠবড়ি গ্রামের আব্দুল্যাহ সানা জানান, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এলাকার বাড়িঘরসহ বিভিন্ন জায়গা লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। এই ক্ষতি থেকে কাটিয়ে তুলতে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে জরুরি ফান্ড গঠন করা জরুরি প্রয়োজন এবং ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তনের খাতে বেশি বরাদ্দ রাখতে হবে। তবে তাৎক্ষণিক ক্ষতি কাটিয়ে তোলা সম্ভব হবে।
ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, কয়রায় প্রতিনিয়ত নদনদীর বাঁধ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু প্রভাবের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ এলাকার বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন সময় নদী ভাঙনের ফলে এলাকা ছেড়ে লোকজন অন্য এলাকায়ও আশ্রয় নিচ্ছে।
উত্তর বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ সরদার নুরুল ইসলাম কোম্পানি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টি পানির মাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পানি এমনিতেই লবণাক্ত। এরপর প্রতি বছর বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকার সবকিছু লোনা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, আর কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অপর দিকে সুপেয় পানিরও অভাব দেখা দিচ্ছে। এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এলাকায় ক্ষতি কাটিয়ে তুল গেলে স্থানীয় সরকার বিভাগকে সম্পৃক্তা করে পরিকল্পনা করতে হবে।
কয়রা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. অব্দুল্যাহ আল মাহমুদ জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে ফসলের জমিতে লবণ পানি ঢুকে নিয়মিত ফসল উৎপাদন ব্যাহত করে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ফসলের জমির উপরের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ এস এম শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করে। এতে যেমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তেমনি অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে। তাৎক্ষণিক বেড়িবাঁধের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় সরকার বিভাগের হাতে জরুরি ফান্ড রাখা প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন