রাঙামাটির লংগদুতে কয়েকশ কৃষক, দিনমজুর, বিধবা ও জেলের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। সোনালী ব্যাংক থেকে তাদের নামে এসব ঋণ তোলা হলেও ভুক্তভোগীরা কিছুই জানতেন না।পরে ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে নোটিশ পাঠালে বিষয়টি জানাজানি হয়। এক এক করে কয়েকশ ভুক্তভোগীর নাম উঠে আসে। পুলিশের এক তদন্তে সংখ্যাটি ৫০৬।
ভোক্তভোগীদের অভিযোগ, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে সরকারি সহয়তা প্রদানের নামে স্থানীয় কৃষকদের ঋণের ফাঁদে ফেলেছে একটি চক্র। ২০১২ সালের বিভিন্ন সময় সরকারি সহায়তা প্রদানের আশ্বাসে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ঋণের ফাঁদে ফেলেছে স্থানীয়দের। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে একটি দাললচক্র এই কাজ করেছে বলে তারা অভিযোগ করছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রথম অংশের সঙ্গে অন্যজনের দ্বিতীয় অংশ জুড়ে দিয়ে ভুয়া কাগজ তৈরি করে তাদের নামে কৃষি ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। কার্ডে উল্লেখিত নাম, জন্ম তারিখ, পিতা ও মাতার নামের অংশ ঠিক রেখে পেছনের ঠিকানার অংশটি পরিবর্তন করা হয়েছে। এভাবে সবার সঙ্গে প্রতারণা করে ঋণের ফাঁদে ফেলা হয়েছে। যা তারা আগে জানতেন না। ভুক্তভোগী লোকজনের মধ্যে রয়েছেন কৃষক, দিনমজুর, বিধবা ও জেলে। এই ঋণ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন ভুক্তভোগীরা। তারা মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। রোববার (১৪ জানুয়ারি) তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
সরকারি সুবিধার নামে কৃষকসহ নানা পেশাজীবীর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করার সুবাধে কাউকে কাউকে পাঁচশ বা এক হাজার করে টাকা দিয়ে বিদায় করে প্রতারক চক্র। বিনিময়ে তাদের নামে ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ তোলা হয়।
ভুক্তভোগী হোসনে আরা নামের একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে লংগদু থানার উপপরিদর্শক মো. জয়নাল বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেন। তার তদন্তে ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
তিনি জানান, ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত ৫০৬ জনের নামে এমন ঋণ নেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। যার আগে পরে আরও অনেক আছে। যাদের প্রতিজনের নামে ২৫-৩৫ হাজার টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। যা বর্তমানে সুদে আসলে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ভুক্তভোগীরা গুইলশাখালি, ভাসান্ন্যা আদাম, বগাচত্তরের বাসিন্দা।
লংগদু উপজেলার বগাচত্বর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. নাছির উদ্দিন কৃষি কাজ করে সংসার চলে তার। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক লংগদু শাখা থেকে ৩৪ হাজার টাকা কৃষি ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়েছেন। তার দাবি, তিনি ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ গ্রহণ করেননি। কে বা কারা তার নামে জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে নিয়েছে ঋণ। এখন ঋণ পরিশোধের চাপে দিশেহারা তিনি।
আইন উদ্দিন নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমি কখনো ঋণ নেইনি। কিন্তু ঋণ পরিশোধের নোটিশ পেয়ে আমি হতবাক। কেমনে এই ঋণ পরিশোধ করব। আমরা এর প্রতিকার চাই।
শুধু নাছির উদ্দিন, আইন উদ্দিন নন, ঋণ পরিশোধের এমন নোটিশ পেয়েছেন উপজলোর সফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকেই।
রাঙামাটি লংগদু সোনালী ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক মো. কাসেম জানান, একটি সার্টিফিকেট অনলাইনে চেক করার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে অমিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন থেকে আস্তে আস্তে এসব তথ্য বের হতে থাকে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
এই বিষয়ে লংগদু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত আছি। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ও দালাল চক্র মিলে এই আর্থিক অনিয়ম করেছে। এই ঋণের বোঝা দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব না। এ বিষয়ে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি, কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু তদন্ত করে এটার একটা সুরহা করবেন।’
রাঙামাটি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, এই বিষয়টি আমরা জেনেছি। কয়েকজন আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান জানান, এই বিষয়ে সোনালী ব্যাংক ডিজিএম-এর সঙ্গে কথা হয়েছে। ঘটনাটি তিনিও জানেন। বিষয়টি তদন্ত করবেন। প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাটি কত- সেই বিষয়টি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন