শনিবার সকাল ঠিক ৮টা। নাতনি রাবেয়া খাতুনকে (৫) কোলে নিয়ে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি স্টেশন পার হচ্ছিলেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা বুলু বেগম। প্রায় ২০ বছর ধরে স্টেশনের পাশেই ছোট্ট খুপরি ঘরে ভাত বিক্রি করেন তিনি। জানেন কখন কোন ট্রেন আসবে।
শিডিউল অনুযায়ী সকাল ৮টায় তিনি যখন রেললাইনের ৩ নম্বর লাইন অতিক্রম করছিলেন তখন ওই লাইন দিয়ে কোনো ট্রেন আসার কথা নয়। তাই নিশ্চিত মনেই পার হচ্ছিলেন রেললাইন। কিন্তু ঈশ্বরদী থেকে ওই লাইনেই ঢুকে যায় কমিউটার ট্রেন। মুহূর্তেই কমিউটার ট্রেনটি বৃদ্ধা বুলুর দুই পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বুলুর দুই পা। তবে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে রাখা নাতনি রাবেয়া ছিলেন অক্ষত।
শনিবার (২৭ জানুয়ারি) সকাল ৮টার দিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি স্টেশনের পূর্ব দিকে প্রায় ১০০ হাত দূরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে বুলু বেগমকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, দুই পা হারানো বুলু বেগমের বাড়ি আড়ানি পৌর এলাকার নুননগর মহল্লায়। তার স্বামী রব্বেল আলী স্টেশনে কুলির কাজ করতেন। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। এরপর তিনি স্টেশনে ভাতের হোটেল চালু করেন।
শনিবার বিকালে রামেক হাসপাতালে আহত বুলু বেগমের ছেলে জুয়েল রানা বলেন, বাড়ির পাশেই আড়ানি স্টেশন। শুক্রবার আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ছিল। এজন্য আমরা আজ ভাতের হোটেল খুলিনি। মা ভাতিজিকে নিয়ে কী কাজে যেন স্টেশনের ওপারে গিয়েছিলেন। ফিরে আসতে গিয়েই এমন বিপত্তি ঘটে।
তিনি আরও বলেন, মায়ের কোলে আমার ভাতিজি ছিল। কিন্তু ভাতিজির কিছু হয়নি। অলৌকিকভাবে সে অক্ষত। বেলা ১টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী মায়ের দুই পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছে। কী হবে আল্লাহই ভালো জানেন।
বুকে চাপা কান্না চেঁপে ধরে জুয়েল রানা বলেন, ২০ বছর আগে বাবা মারা যান। তিনি স্টেশনেই কুলির কাজ করতেন। তারপর থেকে মা স্টেশনে ভাতের হোটেল দেন। এখান থেকে যে আয় হতো তা দিয়েই আমাদের ৮ ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। আমরা মায়ের সাথে সেই হোটেলেই কাজ করি। অথচ আজ আমরা মায়ের পা দুটি রক্ষা করতে পারলাম না।
আড়ানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রতিদিন নির্ধারিত সময় সকাল ৭টায় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বিরতিহীন বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। সকাল ৭টায় ট্রেনটি আড়ানি স্টেশনে আসে। কিন্তু ট্রেনটি প্রায় আধাঘণ্টা লেট করে সকাল ৮টায় আড়ানি স্টেশনে আসে। বিলম্বের কারণে আমাদের বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে আড়ানিতে রেখে বনলতাকে পার করে দিতে হবে। একই সময়ে ঈশ্বরদী থেকে কমিউটার ট্রেনটি আড়ানি স্টেশনে পৌঁছাবে। এ জন্য সিল্কসিটিকে এক নম্বরে, বনলতার জন্য দুই নম্বর ফাঁকা রেখে, কমিউটারকে তিন নম্বরে নেওয়া হয়। সাধারণত তিন নম্বরে এই ট্রেন যায় না। এ জন্য সকালে কয়েক দফা মাইকে বলা হয়েছে যে কমিউটার ট্রেনটি তিন নম্বর লাইনে ঢুকবে। ঠিক সকাল ৮টায় কমিউটার ট্রেনটি তিন নম্বর লাইনে ঢুকে যায়। কিন্তু হয়তো বুলু বেগম মাইকিং শোনেননি। যার কারণে অসাবধানতাবশত তিন নম্বর লাইন পার হওয়ার সময় তিনি ট্রেনের নিচে পড়ে দুই পা হারান।
মন্তব্য করুন