মোস্তাফিজার রহমান, পীরগাছা (রংপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৫:৩৯ এএম
অনলাইন সংস্করণ

ভালো নেই রংপুরের কুমারেরা, বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প

কুমারদের তৈরি মাটির জিনিসপত্র রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। ছবি : কালবেলা
কুমারদের তৈরি মাটির জিনিসপত্র রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। ছবি : কালবেলা

মৃৎশিল্প অতি প্রাচীন একটি শিল্পের নাম। আবহমান বাংলায় এই মৃৎশিল্পের বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে কুমার বা কুম্ভকার। প্রাচীনকাল থেকে এই শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাল বর্ণের লোকেরা। পালরা মাটি দিয়ে কঠোর পরিশ্রমে সুনিপুণ হাতে তৈজসপত্র তৈরির মাধ্যমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আশির দশকের দিকেও গ্রামের মানুষরা মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, বদনা, মুড়ি ভাজার খোলা, কোলা, ভাটি ও মঠসহ গৃহস্থালির নানা বস্তু ব্যবহার করতো। আর এসব তৈরি হতো কুমারপল্লীতে।

বিশ্বায়নের ফলে ওসব এখন অচল ও বিলুপ্তির পথে। এখন কুমাররা মাটির তৈরি নার্সারির টব, দইয়ের পাতিল, বাটনা, ঢাকনা আর কিছু দেবদেবীর মূর্তি বানানোর কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। তারপরও যারা এখনো বংশ পরম্পরায় এই পেশার মায়া কাটাতে না পেরে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সঙ্গী হয়েছে অভাব-অনটন। একে তো জীবিকার দুর্দিন তার উপর অভিযোগ রয়েছে এই জনগোষ্ঠীরা নাকি পান না কোনো সরকারি সহযোগিতা। সব মিলিয়ে ভালো নেই রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কুমার সম্প্রদায়ের লোকজন।

সরেজমিনে শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে উপজেলার দুধিয়াবাড়ী কুমারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কেউ কেউ মাটি দিয়ে দইয়ের সড়া, টব, বাটনা তৈরির কাজ করছেন। কোথাও সেগুলো রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। কেউ আবার শুকানো মাটির জিনিসগুলো পোড়ানোর জন্য চুল্লির উপরে থরে থরে সাজাচ্ছেন। আবার কোথাও বা বিক্রির জন্য ভ্যানের উপর সাজানো হচ্ছে মাটির জিনিসগুলো।

এ সময় ওই গ্রামের সত্তোর্ধ বৃদ্ধা রামদাস পাল, ধরণী পাল, সুবল মহন্ত, রনজিত পাল কালবেলাকে বলেন, এই শিল্পটি আর আগের মত নেই। স্টিল, সিরামিক, মেলামাইন, প্ল্যাস্টিক ও সিলভারের তৈজসপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এখন মাটির জিনিষের চাহিদা নাই বললেই চলে। বেচা-বিক্রি কমে গেছে। এই এলাকায় এখন আর মাটি পাওয়া যায় না। বদরগঞ্জ উপজেলা থেকে মাটি ট্রাকে করে কিনে আনতে হয়। মাটির দাম, জ্বালানী খরচ বেড়েছে। সেই অনুযায়ী আয় হয় না। অনেকেই পেশা বদল করছেন। সরকার থেকে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনা। আগে এই গ্রামের সবাই এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন মাত্র ৪০টি পরিবার এই কাজের সাথে যুক্ত আছি। আমরা যারা এই পেশার মায়া ছাড়তে পারছি না, তারা কষ্ট হলেও বাপ-দাদার এই পেশাটাকে ধরে রেখেছি।

এ সময় আতশী রানি পাল কালবেলাকে বলেছেন, ৩০০ নার্সারির টব তৈরি করতে প্রায় ৩-৪ দিন লাগে। বিক্রি হয় মাত্র ১ হাজার থেকে ১২শ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে কাঁচামাল ও জ্বালানি খরচ। সব মিলে আমরা পুষিয়ে উঠতে পারি না। সংসার চালাতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারি না।

এসময় সুমতী রানী নামে নারী মৃৎশিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, আপনার মতো অনেকেই আসে। সবাই শুধু ছবি তোলে, ভিডিও করে নিয়ে যায়। কিন্তু আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাই না। আমাদের যে খারাপ অবস্থা তা কেউ দেখে না। কি লাভ ছবি তুলে, ভিডিও করে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে উপজেলা সমাজসেবা অফিসগুলো অসহায় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুমার অন্যতম। তারা যে শুধু একটা জনগোষ্ঠী তা না, তারা একটি শিল্পের অংশ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ণের একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় তাদের শিল্পটাকে ধরে রাখার জন্য কাজ করা হচ্ছে। তারা এই প্রকল্পের মাধ্যমে যাতে স্বাবলম্বী হয় তা নিয়েও সমাজসেবা অফিস কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে জরিপ করে তালিকা উর্দ্ধতন অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অন্যান্য ভাতা কার্যক্রমও চালু আছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন বলেন, কুমাররা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরকার সর্বস্তরের পেশার জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। কুমারদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তারা চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ঋণ পেতে পারে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ বেশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে

রাস্তা অবরোধ করে দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে ডিএমপির নতুন নির্দেশনা

ভাইরাল মন্তব্যের পর ক্ষমা চাইলেন রিশাদ

সন্ধ্যার মধ্যে যেসব জেলায় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে

একাত্তরের গণহত্যার সহযোগিতায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যার আহ্বান এনসিপির

‘বোঝাপড়ায় উন্নতি’ হয়েছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের

ইয়েমেনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে ইসরায়েলের হামলা

‘জামায়াত-শিবিরকে কাজে লাগানো শেষ’

সার্বিক ভূমি ও কৃষি সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাব

জুলাই গণহত্যা / শেখ হাসিনা-কামাল-মামুনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা

১০

কার্টআপ নিয়ে এলো ‘মে ম্যাডনেস’ ক্যাম্পেইন

১১

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জামায়াত আমিরের বার্তা

১২

ভারতে গভীর রাতে প্রাণ গেল ১৩ জনের, সবাই নারী ও শিশু

১৩

নিজেদের কৃতিত্বের কথা জানাল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী

১৪

আ.লীগকে নিষিদ্ধ করতে সবার আগে আওয়াজ তুলেছে বিএনপি : পুতুল

১৫

ডিআইইউ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি কালাম, সম্পাদক রাকিবুল 

১৬

অপহরণকালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, নিহত ২

১৭

ভারতের ‘ভিত্তিহীন’ দাবির জবাব দিল পাকিস্তানি বাহিনী

১৮

দেশীয় অস্ত্রসহ মৎস্যজীবী দলের নেতা গ্রেপ্তার

১৯

ভারতের ২৬ ঘাঁটিতে হামলা করে পাকিস্তান

২০
X