দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা তীব্র উত্তেজনা ও রক্তক্ষয়ের পর ভারত এবং পাকিস্তান অবশেষে একটি পূর্ণাঙ্গ ও তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় কূটনৈতিক তৎপরতায় এই যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময়, যখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, তখন তুরস্ক ও ইসরায়েল দুই বিপরীত পক্ষের পাশে অবস্থান নেয়- তুরস্ক পাকিস্তানকে, আর ইসরায়েল ভারতকে সমর্থন করে।
ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘর্ষে তুরস্কের পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে বিবিসি।সেখানে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে তুরস্ক স্বাগত জানালেও সংঘর্ষ চলাকালে দেশটি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। ভারত অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করেছে। একইভাবে পাকিস্তান বলেছে, ভারত ইসরায়েলি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছেন, পাকিস্তানিরা তার কাছে ভাইয়ের মতো এবং তিনি তাদের মঙ্গল কামনা করেন। যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে আগেই তুরস্কের একটি সি-১৩০ জেট পাকিস্তানে অবতরণ করে, যা তেল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে বলে জানানো হয়। এর আগে তুরস্কের একটি যুদ্ধজাহাজ করাচি বন্দরে নোঙর করে, যাকে ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে ভারতের দাবি, এই জেট ও যুদ্ধজাহাজে করে তুরস্ক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
ভারত দাবি করেছে, পাকিস্তান বৃহস্পতিবার প্রায় ৩০০-৪০০ তুর্কি ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন ভারতীয় শহরে আক্রমণ চালিয়েছে। ভারতের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের অস্বস্তি আরও বোঝা যায় এ থেকে যে ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কখনো তুরস্ক সফর করেননি। ফলে, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে দূরত্ব স্পষ্ট।
মতাদর্শিক ঘনিষ্ঠতা ও ধর্মীয় সংযোগ
সৌদি আরবে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত তালমিজ আহমেদ ব্যাখ্যা করেন, পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে দীর্ঘদিনের মতাদর্শিক ও নিরাপত্তাভিত্তিক সম্পর্ক রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তুরস্কের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও বিদ্যমান।
এরদোয়ানের শাসনামলে ধর্মীয় সংযোগ আরও জোরালো হয়েছে। তিনি ইসলামি নেতার ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন এবং প্রায়ই কাশ্মীরকে ইসলামি ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেন। এ কারণে তুরস্ক কাশ্মীর ইস্যুতে বরাবর পাকিস্তানের পাশে থেকেছে।
অস্ত্রবাজার ও কৌশলগত লক্ষ্য
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরের প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নভোদ্বীপ সুরি মনে করেন, তুরস্ক কেবল মতাদর্শ নয়, বাস্তবিক দিক থেকেও পাকিস্তানের অস্ত্রবাজার দখল করতে চায়। ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বে আসার আকাঙ্ক্ষাও এরদোয়ানের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যদিও সৌদি আরব সে প্রচেষ্টা ব্যাহত করেছে।
২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় ইসলামি নেতৃত্ব গঠনের চেষ্টা করেছিলেন এরদোয়ান ইরান ও পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে। তবে সৌদি চাপের মুখে পাকিস্তান সে সম্মেলনে অংশ নেয়নি। এরপরও পাকিস্তান ও তুরস্কের সম্পর্ক দৃঢ় রয়েছে, বিশেষ করে ধর্ম ও সামরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে।
ইসলামিক ঐক্য ও ভূরাজনৈতিক মিত্রতা
তুরস্ক ও পাকিস্তান বহু বছর ধরেই পরস্পরের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া ইস্যুতেও তাদের ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে। পাকিস্তান একমাত্র দেশ যারা আজও আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি দেয়নি। নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজানকে সমর্থন করে পাকিস্তান, তুরস্কও একই অবস্থান নেয়। প্রতিদানে কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্ক পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়।
ভারতের দৃষ্টিকোণ
তালমিজ আহমেদ মনে করেন না যে তুরস্কের এই অবস্থান ভারতের জন্য বড় কোনো কৌশলগত সমস্যা তৈরি করবে। কারণ, ভারতের মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে সৌদি আরব, ইসরায়েল, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানের মতো দেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই তুরস্কের পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানো ভারতের জন্য অস্বস্তিকর হলেও বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের এই সীমিত সময়ের সংঘর্ষ ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ংকর বার্তা দিয়ে গেল। তা হলো- যুদ্ধ যত সংক্ষিপ্তই হোক না কেন, তার আর্থিক, কূটনৈতিক এবং সামাজিক অভিঘাত হতে পারে বহুগুণ বেশি। প্রতিরোধ, শান্তি ও পারস্পরিক সমঝোতাই হতে পারে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার একমাত্র পথ।
মন্তব্য করুন