বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এক স্কুলের ৬৬ ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা, বীরপ্রতীক ৩

বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর কো অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি : কালবেলা
বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর কো অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি : কালবেলা

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। দেশকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন বিভিন্ন বয়সী সাধারণ মানুষ।

তেমনি বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬৬ জন শিক্ষার্থীও অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বীরের মতো লড়াই করেছেন সেই ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র বশির আহমেদ, নূর ইসলাম ও মতিউর রহমান।

জানা গেছে, জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর এলাকা। পাশেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ। কৌশলগত কারণে ধানুয়া কামালপুর ছিল পাক হানাদার বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে কামালপুরে ঘাঁটি গড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কামালপুর দখলে নিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে পা হারান কর্নেল আবু তাহের।

যুদ্ধে শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। তবুও থেমে থাকেননি মুক্তিযোদ্ধারা। অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর। কামালপুরে এমন বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বীরবিক্রম, বীরউত্তম ও বীরপ্রতীক খেতাব পান ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানিতে মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ চলছে এমন খবর চলে আসে ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নাম লেখাতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধার খাতায়। একে একে ৬৬ জন শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ছুটে গেলেন ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুবাহিনীর ওপর। দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের পতাকা।

ধানুয়া কামালপুর কো অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। দেশের পরিস্থিতি আমরা বুঝে গিয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক আমাদের কাছেও পৌঁছে গেছে। গ্রাম হলেও নানা মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের খবর পাচ্ছিলাম। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে গিয়ে দেখতাম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। সমবয়সী অনেকেই যুদ্ধে যাচ্ছে দেখে নিজেকে ঘরে রাখা কঠিন হয়ে গেল। চলে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের স্কুলের ৬৬ জন ছাত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।’

জানা গেছে, ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের বললেন, কামালপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে। মুক্তিবাহিনীর হাজারো সদস্যের মধ্যে কেউ সাহস করে বলতে পারছিল না কে যাবে। তিনি যখন দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা বলে উঠলেন, আমি যাব চিঠি নিয়ে। সেই কিশোর যোদ্ধা সাহসী বশির আহমেদ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বীরপ্রতীক বশির আহমেদ বলেন, ‘স্কুলের ১০০ গজ দূরেই ক্যাম্পটি। আত্মসমর্পণের চিঠিটি পকেটে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাতে থাকা সাদা পতাকা নাড়ালাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, শত্রুপক্ষের ছোড়া একটি গুলিই জীবন কেড়ে নিতে পারত।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী একসময় ক্যাম্পের ভেতরে ডেকে নেয়। আত্মসমর্পণের চিঠি পৌঁছে দেই বিওপির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে। চিঠি পেয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না পাক বাহিনী। এরমধ্যে মিত্রবাহিনীর যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করে পাকিস্তানি ক্যাম্পে। আমাকে বাংকারে ঢোকানো হলো। কয়েকজন সৈনিক হতাহত হলো।’

এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে গেল। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর আরও একজন এলেন আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমান। চারপাশ থেকে হামলায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শত্রুমুক্ত হয় কামালপুর রণাঙ্গন।’

বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমি গর্বিত যে আমার এই বিদ্যালয়ের ৬৬ জন প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৬৪ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় আশপাশের এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। সবাই কামালপুরেই পড়তে আসত। প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী ছিল বলে জেনেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এক রণাঙ্গন ছিল বলে স্কুলের এত ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বিষয়টি আমাকে প্রতিদিনই সকল কাজে উৎসাহিত করে। আমি গর্বিত এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে।’

ধানুয়া কামালপুর ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান লাকপতি বলেন, ‘১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭১ সালে এই বিদ্যালয় থেকে ৬৬ জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এটা অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। এই ইউপির চেয়ারম্যান হিসেবে গর্বিত আমি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

ইসরায়েলের ওপর নতুন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বাজল সাইরেন

হাবিবের শতকে সিএপিএলের গ্রুপ ম্যাচে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের জয়

গোপনে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা, যুব মহিলা লীগ নেত্রী গ্রেপ্তার

ম্যানেজার পদে নিয়োগ দিচ্ছে র‍্যাংগস গ্রুপ

কুষ্টিয়ায় ৬ হত্যা / বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হানিফের, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে ছাত্রদলের কর্মসূচি ঘোষণা

এসএসসি পাসেই চাকরি দিচ্ছে আড়ং

মারা গেলেন বিশ্বকাপজয়ী তারকা ক্রিকেটার

কারিতাস বাংলাদেশে চাকরির সুযোগ, দ্রুত আবেদন করুন

১০

ইতিহাসে প্রথমবার স্বর্ণের দাম ছুঁয়েছে ৩৯০০ ডলার

১১

ক্লাব ব্যস্ততা শেষ করে হংকং ম্যাচ খেলতে ঢাকায় হামজা

১২

২১ লাখ মৃত ভোটার চিহ্নিত, অনেকেই ভোট দিতেন : সিইসি

১৩

খালে কুমির আতঙ্ক, পানিতে নামতেই ভয় স্থানীয়দের

১৪

হত্যা মামলায় দীপু মনি রিমান্ডে 

১৫

বক্স অফিসে দাপট দেখাচ্ছে ‘কান্তারা টু’

১৬

কনমেবল লিগা অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্ট / চরম নাটকীয় ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল

১৭

এলপি গ্যাসের দাম বাড়বে না কমবে, সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার

১৮

সবচেয়ে বড় বিচারক জনগণ, আ.লীগের বিচার প্রসঙ্গে তারেক রহমান

১৯

মুখ থেঁতলে বৃদ্ধাকে হত্যা, স্বর্ণালংকার খুলে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা

২০
X