মিশু দে, রাঙামাটি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ০৯:৪৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিশ্ব পানি দিবস

রাঙামাটিতে এখনো সুপেয় পানির সংকটে ৩৪ শতাংশ মানুষ

কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন রাঙামাটির দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নের দুজন নারী। ছবি : কালবেলা
কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করছেন রাঙামাটির দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নের দুজন নারী। ছবি : কালবেলা

রাঙামাটির দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নের শান্তি চাকমা দুই মেয়ে ও স্ত্রীর নিয়ে চার সদস্যের ছোট পরিবার। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি পান করেন এবং কিছু পানি সংরক্ষণ করেন। সে পানি শেষ হলে ছড়ার পানি পান করেন। আর যখন ছড়ার পানি শুকিয়ে যায় তখন কুয়ার পানি পান করেন। আর তার বাড়ি থেকে ছড়া ও কুয়ায় সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় কয়েকশ’ ফুটের দুটি উুঁচু-নিচু পাহাড়। তেমনিভাবে দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নের প্রায় ১২ হাজার মানুষের একই প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হয় সুপেয় বা বিশুদ্ধ পানি এমনকি দৈনন্দিন কাজের ব্যবহারের পানিও।

দুর্গম দুমদুম্যা ইউনিয়নের মানুষের সুপেয় পানির উৎস বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির সংরক্ষিত পানি শেষ হলে ছড়ার পানিতেই ভরসা।

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলার ৬৬ শতাংশ মানুষকে তারা সুপ্রিয় পানির আওতায় আনতে পেরেছেন, বাকি ৩৪ শতাংশ মানুষের কাছে সুপ্রিয় পানি নিয়ে তারা এখনো পৌঁছাতে পারেনি।

রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি এলাকার হাজারো মানুষ ধুঁকছে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে। পাহাড়ি বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে বসবাস করার কারণে এইসব এলাকার মানুষদের ব্যবহার করতে হয় পাহাড়-ঝিরি-ঝর্ণা আর বর্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে। এই ঝিরি ঝর্ণার পানির ওপর নির্ভর করে দৈনন্দিন রান্না থেকে শুরু করে সকল কাজ করতে হয় তাদের। পানও করেন এই পানি। তবে ফাল্গুন চৈত্রের তাপদাহ শুরু হলে শুকিয়ে যায় ঝর্ণা ঝিরি। সংকট দেখা দেয় সুপেয় পানির তখন ঝিরিতে মাটি খুঁড়ে তৈরি করা হয় কুয়া। পাহাড়ি পথ বেয়ে সেখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় পানি। এসব কুয়ার মুখ সবসময় খোলা থাকায় তাতে পাহাড়ের নানা বন্যপ্রাণী মুখ দেয়, এতে কুয়ার পানি দুষিত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। কিছু কিছু এলাকায় টিউবওয়েল বসানো হলেও সেখানেও শুষ্ক মৌসুমে পানি মিলে না। আর গ্রীষ্মের তাপদাহ বাড়লে এইসব কুয়ার পানিও শুকিয়ে যায়। তখন সন্ধান করতে হয় আশপাশের কুয়ার।

আর যখন ছড়ার পানি শুকিয়ে যায় তখন কুয়ার পানিতেই তৃষ্ণা মেটে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষজনের।

তবে ভুক্তভোগী বয়োবৃদ্ধরা বলছেন, অতীতে এমন পানি সংকট ছিল না। তখন গাছপালা বেশি ছিল। ঝিরি ঝর্ণায় পানি থাকতো। বর্তমানে অবাধে গাছপালা কাটা, পাহাড় কাটা, অবিচারে পাথর উত্তোলনের কারণে ঝিরি ঝর্ণা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখন আর পানি জমে থাকছে না। দিন দিন বাড়ছে জনসংখ্যা। তাতে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে পাহাড়ে বসবাসরতদের ওপর। তীব্র হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট।

একই অবস্থা রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নের যৌথখামার এলকার রূপনা চাকমা জানান, তিনি তার খাবার ও ব্যবহার্য পানি শুষ্ক মৌসুমে সংগ্রহ করেন কুয়া থেকে আর তার বাড়ি থেকে সে কুয়ায় আসতে সময় লাগে প্রায় ১৫-২০ মিনিটি। আর বর্ষায় বৃষ্টির পানিই ভরসা তাদের।

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সুপেয় পানির আওতায় রাঙামাটির ৬৬ শতাংশ মানুষ। এই পানি সংকট সংকট জুরাছড়ির দুমদুম্যা কিংবা রাঙামাটি সদরের সাপছড়ি ইউয়িনের ধেপ্পাছড়ি, নাড়াইছড়ি, যৌথখামার এলাকার নই সেটি রাঙামাটির জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, লংগদু ও রাঙামাটি সদর উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামগুলোর নিত্য চিত্র এটি।

পবিবেশবাদীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়কাটা বৃক্ষনিধন ও পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পাথর উত্তোলনের কারণে সুপেয় পানির সংকট দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকট নিরসনে পার্বত্যাঞ্চলের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন। কারণ এই অঞ্চলের গঠন সমতলের চেয়ে ভিন্ন।

বাড়ি থেকে ছড়া ও কুয়ায় সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় কয়েকশ’ ফুটের দুটি উুঁচু-নিচু পাহাড়।

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র অনুসারে, রাঙামাটিতে ৬৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে। তবে ২০১১ সালের পর থেকে রাঙামাটিতে কত শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় এসেছে তার কোনো জরিপ করা হয়নি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, জেলার সকল মানুষকে সুপ্রিয় পানির আওতায় আনার জন্য কাজ করছেন তারা। পাহাড়ি বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকা ও ডিপ টিউবয়েল বসানো না যাওয়ায় এতে কিছুটা সময় লাগছে। তারা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে জিএফএস প্রকল্পের মাধ্যমে ঝর্ণার পানি বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে গ্রামে সরবরাহ করণ, যেসব স্থানে সম্ভব সেসব স্থানে প্রতি ১০টি পরিবার নিয়ে নলকূপ স্থাপন প্রকল্প, যেসব স্থানে বিদ্যুৎ নেই সেখানে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সোলার পাম্প স্থাপন করে পানি সরবরাহ করা। এ ছাড়াও রুলাল ওয়াটার প্ল্যানের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজ এর সংগঠক হেফাজত সবুজ জানান, এখানে অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষনিধন ও পাহাড়ের পাদদেশ হতে পাথর উত্তোলনের ফলে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে ঝিরি ও ঝর্ণাগুলোতে পানি এখন পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পানির সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে। পাহাড়ের ভৌগোলিক দিক সমতলের চেয়ে ভিন্ন, যে কারণে সমতলের পদ্ধতিতে এখানে সুপেয় পানির সংকট নিরসনের চেষ্টা না করে গবেষণার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এই সমস্যা নিরসনে সরকারের উদ্যোগ আশা করছি।

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী (সদর) সুব্রত বড়ুয়া জানান, রাঙামাটিতে অনেক এলাকায় পাহাড়ের গঠন পাথরের হওয়ায় আমরা ডিপ টিওবয়েল স্থাপন করতে পারছি না। আবার অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নাই। যে কারণে সকল মানুষের কাছে সুপ্রিয় বা নিরাপদ পানি নিয়ে আমাদের পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শতভাগ মানুষের কাছে সুপ্রিয় পানি পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। সে জন্য জিএফএস, সোলার পাম্পের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, কমিউনিটি ভাগে নলকূপ স্থাপনসহ বেশ কিছু প্রকল্প আমরা গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি এই সব প্রকল্পের সুফলও আসতে শুরু করেছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

শুটিংয়ের প্রলোভনে মডেলকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অতঃপর...

কেয়ামতের দিন যে ৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্বয়ং মহান আল্লাহ বাদী হবেন

বাম চোখ লাফালে কী হয়? যা বলছেন বিশেষজ্ঞ আলেম

২৩ নভেম্বর : আজকের নামাজের সময়সূচি

লবণ নাকি চিনি, কোনটি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে?

হল ত্যাগের নির্দেশ, ঢাবিশিক্ষার্থীদের প্রতি তাসনিম জুমার যে অনুরোধ

ভূমিকম্প আতঙ্কে হল ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান ইডেন শিক্ষার্থীদের

৭ ঘণ্টা পর রাজশাহীর সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় সংঘর্ষ, আহত অনেক

১০

ক্যাম্প ন্যুতে বার্সার রাজকীয় প্রত্যাবর্তন

১১

জনগণকে নিয়ে এলাকার কল্যাণে কাজ করব : রবিন 

১২

দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে ৭৬ ক্লাবকে নিয়ে কোয়াবের চা-চক্রের আয়োজন

১৩

ভূমিকম্প আতঙ্কে ঢাবি ভিসির বাসভবনের সামনে শুয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা

১৪

এবার নিজেদের মাঠে নাস্তানাবুদ লিভারপুল

১৫

ভূমিকম্পে নিহতদের সম্পর্কে যা বলেছেন নবীজি (সা.)

১৬

তারেক রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে কোরআন বিতরণ 

১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ দিন বন্ধ ঘোষণা, হল ত্যাগের নির্দেশ

১৮

সিমেন্ট কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ, ৬ শ্রমিক দগ্ধ

১৯

বাংলাদেশ সমাজকর্ম শিক্ষক সমিতির আত্মপ্রকাশ 

২০
X