নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় টেপাখরিবাড়ি ইউনিয়নের পণ্ডিতপাড়া গ্রামে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সাধারণ সদস্য পদপ্রার্থী (বৈদ্যুতিক পাখা) ফেরদৌস মিয়ার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও আনসার ভিডিপি সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
ডিমলা থানা সূত্র জানায়, গত ১৭ জুলাই ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ খড়িবাড়ি পণ্ডিতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যা ৭টায় কেন্দ্রে ফল প্রকাশ করা হয়। ভোটের ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য পদপ্রার্থী ফেরদৌস মিয়ার সমর্থকরা বিজিবি, পুলিশ ও আনসার ভিডিপি সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় ফেরদৌস মিয়ার সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত ছয়টি গাড়িও ভাঙচুর করে। এ অতর্কিত হামলায় কয়েকজন বিজিবি ও পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেক চেষ্টার পর বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন : নির্বাচনী সহিংসতা : টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য গ্রাম
সোমবারের (১৭ জুলাই) ওই সংঘর্ষের ঘটনায় পরদিন মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিজিবির নায়েক সুবেদার নজরুল ইসলাম ডিমলা থানায় বাদী হয়ে ২১ জন নামীয় ও অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে মুন্সিপাড়া গ্রাম।
শুক্রবার (২১ জুলাই) সরেজমিনে দেখা যায়, দিনের বেলায় হাতেগোনা কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ ও ছোট ছেলেদের দেখা গেলেও রাতে সে সংখ্যা নেমে আসে শূন্যের কোঠায়। সংঘর্ষের পর থেকে গ্রামের বাসিন্দারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে নারী ও শিশুরাই শুধু অবস্থান করছেন। তাদের চোখে-মুখেও রয়েছে আতঙ্কের ছাপ। এলাকাজুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। মহিলারাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী মসজিদে জুমার নামাজ আদায় হয়েছে ঠিকই কিন্তু গ্রেপ্তার আতঙ্কে মুসল্লিদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এ ছাড়া দক্ষিণ খড়িবাড়ি পণ্ডিতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কম। আর তাতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। এ ছাড়াও ইউপি কার্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছোট একটি বাজার থাকলেও ১৭ জুলাই নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে সব দোকানপাট। বর্তমানে গ্রামটি একেবারে পুরুষশূন্য অবস্থায় রয়েছে।
ওই গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সুবহান বলেন, ‘ভোট দিয়া আইস্যা আমি বাড়িতে ছিলাম, কিন্তু এখন দেখি অবস্থা খুবই গরম। গ্রামের অনেক লোক বাড়িঘর ছাইড়া অন্য জায়গায় চইল্যা গেছে। এখানে অনেক পরিবারের ঘরের বাজার পর্যন্ত বন্ধ। পুরুষ না থাকার কারণে গ্রামের অনেক লোক অসহনীয় কষ্টে জীবনযাপন করতাছে।’
স্থানীয় বিলকিস বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী চাল বিক্রি করে সংসার চালায়। সে বাড়িতে না থাকায় আমরা নিদারুণ কষ্টে আছি। দেখেন, আমাদের বাড়িতে ডায়াবেটিসের রোগী রয়েছে। ইতোমধ্যে তার দুই পায়ের দুটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। এখন সে গুরুতর অসুস্থ, বিছানায় পড়ে আছে। কোনো ওষুধপত্র নেই। সে এখন মৃত্যু পথযাত্রী।’
ওই গ্রামের অপর বাসিন্দা জুলহাস মিয়া বলেন, ‘এই গ্রামটি এখন সম্পূর্ণ পুরুষশূন্য, কাউকেই বাড়িতে পাবেন না। কারও বাড়িতে বাজার সদাই নেই, অনেক পরিবার অসহনীয় দিনাতিপাত করছে। আমার বাড়িতে ছয়জন পুরুষ, অথচ আমি ছাড়া একজনও নেই।’
আরও পড়ুন : সহিংসতার ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিকের ওপর হামলা
স্থানীয় সুধী মহলের দাবি, নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় শুধু যারাই অভিযুক্ত, যাদের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে, তাদেরই আইনের আওতায় আনা হোক। অযথা নির্দোষ, নিরীহ ব্যক্তিরা যেন হয়রানির শিকার না হয়।
এ বিষয়ে কথা হয় গ্রেপ্তার হওয়া তাসিন ইসলামের বাবা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের শুটিবাড়ী বাজারে আমরা তুষার পান স্টোর নামে একটা পানের দোকান করি। রাত ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকান। সেদিনও খোলা ছিল। দোকান ২টার দিকে বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে টেপাখরিবাড়ি পরিষদ বাজার এলাকা থেকে আমার ছেলেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। রাতে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নেওয়ার পর মঙ্গলবার সকালে জানতে পারি, পরিষদে মারামারির ঘটনায় তাসিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যায় মারামারির সময় তাসিন দোকানে বেচাকেনায় ব্যস্ত ছিল। ওই ছোট পানের দোকানে আমার পরিবারের ১০ জনের সংসার চলে। ছেলে গ্রেপ্তারের দুশ্চিন্তায় আমি দুদিন থেকে দোকান খুলতে পারছি না। আমার ছেলে নির্দোষ। তাকে মুক্তি দেওয়া হোক, এটা আমার দাবি।
কথা হয় অপর ভুক্তভোগী ফজল মিয়া ওরফে রানা মিয়ার মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার পোলা রানা দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ি আসছিল। কিন্তু পুলিশ নাকি তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার পোলা তো সারাটা দিন শুটিবাড়ির দোকানে ছিল। সে তো কিছুই জানত না, তারপরও আমার পোলাটারে নিয়া গেল। আমরা এখন কি করব। আমার পোলাডারে এনে দাও বাজান। তার আয় রোজগারে আমাদের পরিবার চলে। আমার বাপজান নির্দোষ, আমি তার মুক্তি চাই।’
ডিমলা থানার ওসি লাইছুর রহমান বলেন, সংঘর্ষের এলাকায় অভিযান চালিয়ে আমরা এ পর্যন্ত আব্দুল করিম (৪০), তাসিন (২৩), রবিউল ইসলাম (৩০), কামিনুর রহমান (৩৪), ফজল মিয়া রানা (৩৫), মো. মাসিদুল ইসলাম (৩০), মো. হাবিব (৩০), মো. ফরহাদ আলী (৩৫), মো. হাবিবুর রহমান হাবু (৩০), মো. আনিসুর রহমান (৩৩), মো. আবু জাহিদ (৩৮) নামের এই ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছি। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হবে না।
মন্তব্য করুন