চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুবলীগের সাবেক নেতা খাইরুল আলম জেম খুন হন ছয় মাস আগে। এ মামলার প্রধান আসামি সেখানকার পৌর মেয়র মুখলেসুর রহমান। তার নাম এসেছে পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও। কারাগারে যাওয়ার চার মাসের মাথায় গত বৃহস্পতিবার তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিনের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাকে ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন। একই সঙ্গে তাকে কেন স্থায়ী জামিন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। শুনানিতে আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী।
এই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী। তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে সরকার পক্ষ জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। আশা করছি সোমবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির কাছে আবেদনটি শুনানির জন্য পেশ করা সম্ভব হবে। তবে নিহতের ছোট ভাই মো. মাহবুব উল আলম ফাহিম বলেন, পৌর মেয়র একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। টাকা ও ক্ষমতার প্রভাবে সে যে কোনোভাবে কারামুক্তির চেষ্টা করছে। জামিন পাওয়ার পরই কীভাবে কারামুক্তি পাওয়া যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করবেন সাক্ষীদের হুমকি দেবেন সেই আশঙ্কা করছি। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করছি।
গত ১৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে বাইতুল ইসলাম জামে মসজিদের পার্শ্বে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে আসামিরা হাতুড়ি দিয়ে প্রথমে মাথায় আঘাত করে এবং পরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরি মেরে জেমকে হত্যা করেন। ঘটনার তিন দিন পর মামলা নেয় সদর থানা পুলিশ। ২৬ এপ্রিল হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া টুটুলসহ পাঁচ আসামিকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ওইদিনই তারা আদালতে জবানবন্দি দেয়।
জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে মামলার অন্যতম আসামি মেসবাউল হক টুটুল বলেছেন, ‘কৃষক লীগের সম্মেলনের পরে চাঁপাইনবগঞ্জ পৌর মেয়র মুখলেসুর রহমানের সাথে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় জেমকে পঙ্গু করে ফেলার। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯ এপ্রিল তাকে হাতুড়ি ও চাকু দিয়ে আঘাত করলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর আমি মেয়রকে ফোন করে জেমকে মারার ঘটনা বলি। মেয়র বলে ঠিক আছে, চিন্তার কোনো কারণ নাই। আপাতত দূরে কোথাও চলে যাও।’
জবানবন্দিতে আসামি মেসবাউল হক টুটুল বলেন, ‘আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর কৃষক লীগের সহসভাপতি। পৌর মেয়র মুখলেস গ্রুপের রাজনীতি করি। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর জেলা কৃষক লীগের সম্মেলন নিয়ে জেম এর সাথে আমার গ্যাঞ্জাম শুরু। এই সম্মেলনে জেম এমপি ওদুদের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর আমি মেয়র মুখলেসের পক্ষে অবস্থান নেই। ওই সম্মেলনে জেম বোমাবাজি করেছিল, আমি ওই বোমার আঘাতে আহত হয়েছিলাম। সম্মেলন পরবর্তী বিষয়টি নিয়ে মেয়রের সাথে আমাদের একাধিক বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় জেমকে পঙ্গু করে ফেলার।
টুটুল ছাড়াও আসামি ইব্রাহিম, মো. শামীম রেজা, মাসুদ রানা ও মিলন হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর মধ্যে ইব্রাহিম পৌর কৃষক লীগের ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, আমি মেয়রের সাথে রাজনীতি করি। কৃষক লীগের সম্মেলন থেকে জেমের ওপর আমাদের টার্গেট হয়। জেমের ছোড়া বোমার আঘাতে আমি আহত হই। বিষয়টি নিয়ে মেয়রের সাথে আলোচনা করি। আমরা বলি আপনি থাকতে আমরা কেন বারবার মার খাব। আমরা সবাই ক্ষিপ্ত হই এবং সিদ্ধান্ত নেই জেমকে আমরা মারব। ঘটনার দিন টুটুল ভাই, রানা, শামীম ও আমি জেমকে ঘিরে ধরি। প্রথমে টুটুল ভাই জেমকে হাতুড়ি দিয়ে মাথার পেছনে আঘাত করে। তারপর রানা চাচা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। শামীম টটুল ভাইয়ের কাছ থেকে হাতুড়ি দিয়ে জেমের পায়ে আঘাত করে। আমি জেমকে চাকু দিয়ে ৫/৬টি আঘাত করি।
প্রসঙ্গত, গত ৬ জুন থেকে কারাগারে আছেন মুখলেস। ২০ সেপ্টেম্বর তার জামিন আবেদন খারিজ করে দেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিনিয়র দায়রা জজ মোহা. আদিব আলী। খারিজ আদেশে বলা হয়, আসামি মুখলেস একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে এজাহার বর্ণিত ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, হুকুমদাতা ও আসামিদের সহায়তাকারী হিসাবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। তার জামিন বিবেচনা করা হলে মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের প্রভাবিত করা সম্ভাবনা রয়েছে। পরে মুখলেসুর হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
মন্তব্য করুন