খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) অচলাবস্থা চলছেই। শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতিতে অনড় রয়েছেন শিক্ষকেরা। ৭৭ দিন বন্ধের পর বৃহস্পতিবার ৫ম দিনের মতো শিক্ষকরা ক্লাসে যাননি।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) দুপুরে কুয়েট ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসে সুনসান নীরবতা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে শিক্ষকদের কার্যালয়ে গিয়ে ক্লাস শুরুর জন্য অনুরোধ করছেন।
এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের ওপর হামলায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী মোবরক হোসনের ছাত্রত্ব ও সনদ বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরেই শিক্ষার্থীদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন শিক্ষকরা। একের পর এক এমন ঘটনায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক সমাজে। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা সহজে মেনে নিচ্ছেন না শিক্ষকরা। এতে দূরত্ব বাড়ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে। এসব ঘটনায় ক্লাস বর্জনের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুয়েটে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। শিক্ষকদের অভিযোগ শিক্ষার্থীরা ফেসবুক পেজ খুলে শিক্ষকদের বিষয়ে নানা প্রচার প্রচারণা করছেন। এমন অবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যকার দূরত্ব বেড়েই চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অনেক শিক্ষক নিজ ক্যাম্পাসেই নিরাপত্তাহীনতার সংকটে রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে আম পাড়াকে কেন্দ্র করে খুবির ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের প্রভাষক এবং সহকারী ছাত্র বিষয়ক পরিচালক হাসান মাহমুদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও মারধর করে বাংলা বিভাগের অনিয়মিত ছাত্র মো. মোবারক হোসেন। শিক্ষককে মারপিটের ওই ঘটনায় ছাত্রত্ব ও সনদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটের অডিটোরিয়াম এবং মেডিকেল সেন্টারের ভেতর দুই দফায় শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হয় শিক্ষকরা। কুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাছুদসহ ৪-৫ জন শিক্ষককে মারধর করে শিক্ষার্থীরা। ওই দিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় সাবেক কুয়েট প্রশাসনের ব্যর্থতার জেরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় কুয়েটের একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে শিক্ষকদের ওপর হামলায় জড়িতদের বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এর পর থেকে কুয়েট শিক্ষক সমিতি কঠোর অবস্থান নেয়। প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় কুয়েটের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষকরা তাদের কর্মবিরতিতে অনড়। শিক্ষকদের লাঞ্ছিতকারী শিক্ষার্থীদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন তারা। এমন অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাড়ে ৭ হাজার শিক্ষার্থী।
এর আগে, ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর কুয়েটের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ সেলিম হোসেন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই সময় শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি তদন্ত করে ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনকে স্থায়ী এবং ৪০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক পরিচালক নাজমুস সাদাত শুভ জানান, রাতে ক্যাম্পাসের ভেতর আম পাড়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষককে লাঞ্ছিতের ঘটনা ঘটে। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল করে উপাচার্যের বাসভবনে যায়। অভিযুক্ত ছেলে বাংলা বিভাগের একজন অনিয়মিত ছাত্র। শনিবার সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ বা কারা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অস্থিরতার সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করছে। এ ঘটনা বড় একটি চক্রান্ত হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রদের ভেতর দূরত্ব নেই বলে তিনি দাবি করেন।
কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. ফারুক হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিতর ঘটনায় একের পর এক দূরত্ব বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতি মুক্ত বলা হলেও গুটি কয়েকজন তাদের নিজস্ব সিস্টেম দিয়ে প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয়কে সেভাবে সাপোর্ট দিতে পারছে না। কুয়েটের সাবেক উপাচার্যসহ শিক্ষকদের ওপর যে হামলা হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার না হলে আমরা ক্লাস করাবো না।
মন্তব্য করুন