বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় পুলিশ রিমান্ডের অপব্যবহার এবং এর মাধ্যমে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রক্রিয়াকে ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগত সহিংসতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর সংস্কার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ‘De-Cage Initiative’ এর উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে ‘Confessional Statement: Police Remand as a Procedural Violence in the Criminal Justice System’ শীর্ষক একটি সেমিনারে এমন মন্তব্য করেন অধ্যাপক মাহবুব।
সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকে ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, পুলিশ রিমান্ডের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় একটি পদ্ধতিগত সহিংসতা। আইন অনুযায়ী, অভিযুক্তকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা বা নির্যাতন করার কোনো এখতিয়ার পুলিশের নেই, যা একটি মৌলিক অধিকার। তবে বাস্তবতা এবং সংবিধানের মধ্যে পার্থক্যের কারণে এই আলোচনা জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন যে, সরকার সংশ্লিষ্ট বাহিনী ও দায়িত্বশীল পুলিশ রিমান্ডের বিষয়টি অস্বীকার করলেও, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে রিমান্ড মানেই পুলিশি নির্যাতন।
স্বেচ্ছামূলক স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে অধ্যাপক রহমান বলেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে স্বেচ্ছামূলক বলে প্রত্যয়ন করলে আদালত এটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। এরপর আসামিকে প্রমাণ করতে হয় যে স্বীকারোক্তিটি সত্য নয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, একজন আসামি নিজের শাস্তি জেনেও স্বেচ্ছায় কেন অপরাধ স্বীকার করবে, যদি না অপরাধবোধ বা শাস্তি হ্রাসের মতো কোনো কারণ থাকে।
তিনি আরও জানান, বাইরের অনেক দেশে দ্রুত অপরাধ স্বীকার করলে শাস্তি কমে আসে, কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই। তার মতে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেবলমাত্র বিবেকের তাড়নাতেই একজন মানুষ স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করতে পারে। তিনি সেকশন ১৬৪ কে ‘বাইবেল’ না বলেও মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক রহমান আরও জানান, পুলিশের হেফাজতে থাকা অপরাধীদের একটি ছোট অংশই কেবল স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেয়, যখন পলাতক বা জেল কাস্টডিতে থাকা ব্যক্তিরা তা করেন না। পুলিশ হেফাজতে থাকলেই কেন বিবেক জাগ্রত হয়, এর একমাত্র কারণ হলো নির্যাতন। তিনি বিচার বিভাগকেও পুরো প্রক্রিয়াটিকে পদ্ধতিগতভাবে অস্বীকার করার জন্য দায়ী করেন।
অধ্যাপক রহমান উল্লেখ করেন, অনেক দেশে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার (conviction rate) শতকরা ৯০ ভাগ হলেও বাংলাদেশে এটি প্রায় ১০ ভাগ। তিনি সহিংসতাকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা এবং ‘ইমানসিপেটরি ভায়োলেন্স’-এর নামে এর যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টার সমালোচনা করেন, যা সহিংসতার একটি চক্র তৈরি করে। তার মতে, শুধুমাত্র ‘সিভিল ডিসওবেডিয়েন্স’ হিসেবে সীমিত সময়ের জন্য কিছু মাত্রার সহিংসতাকে সমর্থন করা যেতে পারে, অন্যথায় কোনো প্রকার সহিংসতাকে বৈধতা দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, কোনো ধরনের ‘peaceful reform’ কাজ করবে না এবং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। ২০০৩ সালের BLAST মামলার রায় বা ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন সত্ত্বেও পুলিশি নির্যাতন বন্ধ হয়নি, বরং তার হাইপোথিসিস অনুযায়ী জোরপূর্বক গুম বেড়েছে। তিনি ‘De-Cage Initiative’ এর পক্ষ থেকে আসা একটি নির্দিষ্ট ‘কুলিং পিরিয়ড’ পার না হওয়া পর্যন্ত স্বীকারোক্তি না নেওয়ার প্রস্তাবকে ‘ভালো প্রস্তাব’ বলে মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক রহমান পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, শুধু আইন বা কিছু এজেন্সি দিয়ে হবে না, বরং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সহিংসতামুক্ত জুরিসপ্রুডেন্স ও রাজনৈতিক ডিসকোর্স দরকার। তার মতে, এইগুলো করলে নতুন আইন ছাড়াই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসেন অতিরিক্ত কাজের চাপকে ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ঢাকার ৫২টি থানায় মাত্র ৩৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, যার ফলে সব মামলায় যথেষ্ট সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে ম্যাজিস্ট্রেটরা চাইলেও সব করতে পারেন না। রাজনৈতিক লবিং ও চাপ, দুর্বল প্রসিকিউশনকেও তিনি ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখান। তার মতে, ফৌজদারি মামলায় শতকরা ১০ ভাগের বেশি রিমান্ড দরকার হয় না।
তিনি বলেন, পুলিশ কেন রিমান্ড চাইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেট কেন দেবে, তা তাদের বুঝতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন যে, অনেক সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রাথমিক তদন্ত না করেই রিমান্ডের আশায় বসে থাকেন এবং রিমান্ডের জন্য দুই দিনের সময় নিয়ে কয়েক ঘণ্টাও ঠিকঠাক জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন না। দুর্বল প্রসিকিউশন এবং পুলিশের অসহযোগিতার কথাও তিনি তুলে ধরেন। ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন সেকশন ১৬৪ কে ‘লিগ্যাল ডিফেক্ট’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশনের সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা জানান, অনেক ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পরপরই পুলিশ কয়েকদিন অবৈধ ডিটেনশন করে এবং পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২৪ ঘণ্টা আগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি বলেন, রিমান্ডের পর অধিকাংশ স্বীকারোক্তিই নির্যাতনের মাধ্যমে হয়। অনেক মামলায় পুলিশ নিজেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিখে নিয়ে আসে এবং ম্যাজিস্ট্রেট কেবল সই করে দেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অনেক সময় ফর্মে থানা, মামলার নম্বর, ২৪ ঘণ্টার হিসাব কিছুই থাকে না এবং আসামিকে দুই-তিন দিন পরে কোনো রিমান্ড ছাড়াই হাজির করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুলিশের মনস্তত্ত্ব হলো স্বীকারোক্তি নিতে পারলেই তারা সফল। তিনিও সেকশন ১৬৪ কে ‘বাইবেল’ না বলে এর গুরুত্ব কমানো উচিত বলে মন্তব্য করেন এবং ‘corroborative evidence’-এর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তিনি ‘কুলিং পিরিয়ড’ তিন ঘণ্টা থেকে তিন দিন করার প্রস্তাব দেন।
মানবাধিকার কর্মী মুশফিক জোহান প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তিনি জানান, বর্তমানে ২৫০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদী সলিটারি কনফাইনমেন্টে আছেন এবং অনেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারারুদ্ধ আছেন। তিনি ‘লিভিং উইথ সোশ্যাল ডেথ’-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, যারা মুক্তি পান, তাদেরকে পুরোপুরি আউটকাস্ট করে ফেলা হয়। তিনি একজন ভিক্টিমের কথা উল্লেখ করেন যার মামলা হাইকোর্টে উঠতে বিশ বছর লেগে যায় এবং মুক্তি পাওয়ার পরেও তিনি একাকীত্বে ভুগছিলেন। তার বাবা-মা মারা যাওয়ার সময়ও তিনি তাদের দেখতে পারেননি। জোহান নির্যাতনকে মাধ্যম না করে প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করেন এবং নির্যাতন একেবারেই না থাকার প্রস্তাব দেন।
সেমিনারে উপস্থিত ভিক্টিম আনোয়ার শংকর তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২০০৫ সালে তাকে অজ্ঞাত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং পুলিশ তাকে ক্রমাগত অত্যাচার-নিপীড়ন করে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করে। ২০১৬ সালে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হয় এবং ২০২২ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৭ বছর জেলবন্দি থাকার কারণে তার চারপাশ সম্পূর্ণ বদলে যায়। তিনি বলেন, পুলিশের একটি ভুলের কারণে এবং এই রিমান্ড সিস্টেমের কারণে তার জীবনের ১৭টি বছর নষ্ট হয়েছে। তিনি বিচার প্রক্রিয়ার কার্যকর সংশোধন চান যাতে আর কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানির শিকার হতে না হয় এবং দোষী ব্যক্তিই যথাযথ শাস্তি পায়।
সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম মুসা একটি মামলার কথা উল্লেখ করেন যেখানে একই সময়ে তিন-চারজনের কাছ থেকে নাম বদলিয়ে হুবহু একই স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। তিনি জানান, গ্রেপ্তারের পরপরই রিমান্ড ছাড়াই অভিযুক্তদের একটি বড় অংশের স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাধান এখানে কাজ করবে না এবং এই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে সিভিল পরিসরে জনমত তৈরির বিষয়টি তিনি ব্যক্ত করেন।
মন্তব্য করুন