নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের একটি বড় হাতিয়ার ছিল গণরুম-গেস্টরুম প্রথা। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১৮টি হলে ছাত্রলীগের তৈরি করা এই গণরুম-গেস্টরুমে পিষ্ট হতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বপ্ন, বিপথগামী হতেন মফস্বল থেকে ঢাবিতে পড়তে আসা সহজ-সরল ছেলেমেয়ের অনেকেই। আওয়ামী লীগের পতনের পর এই গণরুম-গেস্টরুমে প্রথার পতন হলেও আবার এই অভিশাপ ফেরার শঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। তাদের দাবি, ঠিক সময়ে হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ শেষে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু না হলে ফিরবে গণরুম-গেস্টরুম কালচার।
জানা যায়, আগামীকাল বুধবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ঢাবিতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া নবীন শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দূরদূরান্ত থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখনো দেওয়া হয়নি হলের সিট বরাদ্দ। এমনকি কয়েকটি হল বাদে সিট বরাদ্দের কোনো কার্যক্রমই শুরু করতে পারেনি অধিকাংশ হল। যার ফলে শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবাসন নিয়ে আছেন চরম দুশ্চিন্তায়।
আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে অনেক শিক্ষার্থী তাদের এলাকার ‘বড় ভাই’ ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত এমন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে হলে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল বলে মনে করছেন। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনেকেই বলছেন, এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগ একসময় গণরুম তৈরি করেছিল। পরে সেখান থেকে সূচনা হয় গেস্টরুম নামক টর্চার সেলের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রাধ্যক্ষ নাম না প্রকাশ করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, এই সেশনের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে চার মাস আগে। মে অথবা জুন মাসের মধ্যে যদি ডিন অফিসগুলো থেকে আমাদের হল বরাদ্দের বিস্তারিত তথ্য দিতে পারত তাহলে ক্লাস শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের জন্য হলে সিট বরাদ্দ দেওয়া যেত। কিন্তু এখনো অনেক শিক্ষার্থী হলের ভর্তির কার্যক্রমই শেষ করতে পারেননি। যার ফলে সিট বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু করাই এখন অনেক সময়ের ব্যাপার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিব হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান জানান, শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে শিক্ষার্থীদের বরাদ্দকৃত নিজ নিজ হলে রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বর পাঠানো হয়। এরপর হলের সিট বরাদ্দের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে ভাইভা নিয়ে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ প্রয়োজন হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমার হলে ৪৪৭ শিক্ষার্থীকে সিট বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এর মধ্যে এখনো ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী এখনো ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করতে হলেই আসেননি। সবার কাজ শেষ হলে এরপর সিট বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এর মধ্যে ক্লাস শুরু হলে শিক্ষার্থীরা হলে থাকবে কীভাবে?
একদিকে ক্লাস শুরু হওয়া অন্যদিকে হলে সিট না থাকায় বিপদে পড়েছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের হলে সিট বরাদ্দের আগেই হলে জায়গা করে দেওয়া হলে গণরুম-গেস্টরুম ফেরার শঙ্কায় শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, বিগত সময়ে ইচ্ছা করেই বৈধ সিট বরাদ্দের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করা হয়েছিল। যাতে করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে মিছিল-মিটিং করিয়ে দলীয় দাসে পরিণত করা যায়, ছাত্রলীগের অনুগত করা যায়। আমরা চেয়েছিলাম, ক্লাস শুরুর আগেই সব শিক্ষার্থীর সিট বরাদ্দ দেওয়া হবে; কিন্তু সেটা এখনো করা হয়নি। এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে যেসব ছাত্রসংগঠন ক্ষমতায় আসবে তারা গণরুম-গেস্টরুম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ও একাডেমিক অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ৪ দফা দাবি জানান নবীন শিক্ষার্থীরা। এক স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ক্লাস শুরুর আগে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; আসন প্রদানে বিলম্ব হলে উপযুক্ত ভাতা বা বৃত্তির ব্যবস্থা করা; পোষ্য কোটার ভর্তি বাতিল করে মেধা তালিকার শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া; এবং ম্যানুয়েল মাইগ্রেশন চালু করতে হবে। আবাসন সংকট সমাধানে অবিলম্বে আবাসনসংক্রান্ত একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখা।
গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে শাখা শিবির যেসব শিক্ষার্থীর আবাসিকতা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে, তাদের সিট বাতিল করে নবাগতদের জন্য সিট বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি সিট বরাদ্দে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতহীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানায়।
গণরুম-গেস্টরুম প্রথা যাতে আর না ফিরে এ লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ঢাবি শাখা ছাত্রদল। বিবৃতি দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি শাখাও। গতকাল সোমবার দেওয়া এক বিবৃতিতে শাখা ছাত্রদল বিগত সময়ের গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি যেন আর ফিরে না আসে তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি হলে সিটের জন্য আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা এবং অন্যথায় আবেদনকারী যেসব শিক্ষার্থী সিট বরাদ্দ পাবে না তাদের আবাসন বৃত্তির আওতায় এনে তাদের আবাসন প্রাপ্তিতে সহায়তা করার দাবি জানায়।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের বক্তব্য শোনার পর পরে যোগাযোগ করতে বলেন। এক ঘণ্টা পর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও আর তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন