প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও শর্ত পূরণ করা ছাড়াই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মোসা. শামসুন্নাহার।
বুধবার (৪ অক্টোবর) তার পদোন্নতি বোর্ড হওয়ার কথা রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি সুপারিশ না করলেও উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ায় নিয়মবহির্ভূত পদোন্নতি পাচ্ছেন তিনি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৬ এর ৩৬(২) ধারার ১০(৯) সংবিধি অনুযায়ী বিভাগীয় সম্প্রসারণ ও নিয়োগে প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশ করার কথা রয়েছে। তবে অধ্যাপক পদে শামসুন্নাহারের পদোন্নতি পেতে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও শর্তপূরণ না হওয়ায় তার নিয়োগের সুপারিশ করেনি বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি।
জানা যায়, অধ্যাপক পদের পদোন্নতির শর্তাবলি পূরণ না হওয়ায় গত ২৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত সভায় অধ্যাপক পদে তার আবেদন অগ্রায়ণ (ফরোয়ার্ডিং) না করার সিদ্ধান্ত নেয় প্ল্যানিং কমিটি। তবে বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় ৩ সেপ্টেম্বর আবারও সভা ডাকেন তিনি। সে সভায় পদোন্নতির কোনোরূপ সুপারিশ না করেই আবেদন অগ্রায়ণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ ছাড়া প্ল্যানিং কমিটির সভায় ওই সভার কোনো সদস্যের বিষয়ে আলোচনা হলে, নির্দিষ্ট আলোচনার সময় তিনি সভাস্থল থেকে বাইরে থাকার রীতি রয়েছে। তবে শামসুন্নাহার বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সভায় তার আলোচ্যসূচি পর্যালোচনার সময় স্বয়ং উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করেছেন বলে জানা গেছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদোন্নতির নীতিমালার ৩(ক) অনুযায়ী, অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে সহযোগী অধ্যাপক পদে কমপক্ষে ৪ বছর সক্রিয় চাকরির অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ড. শামসুন্নাহার ২০১৯ সালের ২৪ জুন সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। এরপর ২০২০ এর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনা বেতনে ছুটিতে ছিলেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় বিনা বেতনে শিক্ষা ছুটি সক্রিয় অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য হবে কি না এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ না থাকলেও ইতোপূর্বে একই কারণে অনেকে পদোন্নতি পাননি। খোদ লোক প্রশাসন বিভাগেরই অধ্যাপক ড. মাসুদা কামালও এ সংক্রান্ত জটিলতায় এক বছর পরে অধ্যাপক হোন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাতে কোনো কিছু স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের নীতিমালা অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে পূর্ণবেতনে শিক্ষা ছুটির সময়কালকেই সক্রিয় শিক্ষকতা বোঝাবে।
একই কথা বলেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, বিনা বেতনে ছুটি শিক্ষা ছুটি হিসেবে বিবেচিত হলেও সক্রিয় কার্যকাল হিসেবে বিবেচিত হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালায়ও একই কথা বলা হয়েছে। ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালা ২(৭) এ বলা হয়েছে, বিনা বেতনে/লিয়েনে বা অসাধারণ ছুটি সক্রিয় শিক্ষাকাল হিসেবে বিবেচিত হবে না।
এদিকে সহযোগী অধ্যাপক পদেও স্থায়ী হননি ড. শামসুন্নাহার। নিয়মানুযায়ী স্বীয় পদে স্থায়ী হওয়া ছাড়া পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ নেই। এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ড. মোসা. শামসুন্নাহার। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে প্রতিবেদকের কল কেটে দেন। তবে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির এক সদস্য জানান, সভায় তার স্থায়ীকরণের অফিস আদেশ দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ড. শামসুন্নাহার স্বীয় পদে স্থায়ীর কাগজপত্র দেখাতে না পারলেও গত ২১ আগস্ট স্থায়ীকরণের এক সভায় তার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। সিন্ডিকেট সভা না হওয়ায় বিষয়টি এখনো অপেক্ষাধীন। নিয়মানুযায়ী বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি পদোন্নতির আবেদন করতে পারবেন না।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮২তম সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার কথা বলা হলেও লোক প্রশাসন বিভাগে স্বীয় পদে স্থায়ী একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ডিঙিয়ে ড. শামসুন্নাহারকে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন উপাচার্য। বিভাগীয় প্রধান হলেও তিনি সপ্তাহে দুদিনের বেশি বিভাগে উপস্থিত থাকেন না বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় শিক্ষকরা। এতে ওই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হোন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন কানুন না মেনে গায়ের জোরে অনেক কিছু করে থাকে। অনেক সময় না চাইলেও চাপে পড়ে বোর্ড ডাকে কর্তৃপক্ষ। সেখানে তারা বিষয়গুলো সিন্ডিকেটে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সিন্ডিকেটে গেলে নিয়মবহির্ভূত বিষয়গুলো বাতিল হয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে ড. শামসুন্নাহারের স্বামী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হওয়ার প্রভাব দেখিয়েই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক অনিয়ম করে যাচ্ছেন। এমনকি প্রভাব দেখাতে নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের লোগো সংবলিত গাড়ি নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন।
এসব বিষয়ে কথা বলতে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনকে গণমাধ্যমে মন্তব্যের জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে ড. শামসুন্নাহারের পদোন্নতিসংক্রান্ত কোনো প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানেন না দাবি করে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বিনা বেতনে শিক্ষা ছুটিতে থাকলে সেটি সক্রিয় অভিজ্ঞতা হিসেবে গণ্য হবার কোনো সুযোগ নেই।’
মন্তব্য করুন