রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ৬৪৩ নাম্বার বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সোহান। তার এক হাত ও দুই পায়ে ব্যান্ডেজ করা। সেই সঙ্গে কোমরে বেল্ড পরানো।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শাখা ছাত্রলীগের দুপক্ষে সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জননেতা আব্দুল মান্নান হলের তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে ভেঙে গেছে তার এক হাত ও দুই পা। এ ছাড়া ছিঁড়ে গেছে কোমরের স্পাইনাল কর্ডও। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত চার জায়গায় অপারেশন করতে হবে।
তার পাশে বসে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। সন্তান যখন পিতা-মাতার সেবা করবেন, সেই সময় বাবা নিজে গুরুতর অসুস্থ হয়েও ছেলের এই অবস্থা শোনে গাইবান্ধা থেকে ছুটে এসেছেন। বিলাপ করে বলছিলেন আমার সন্তানের এমন অবস্থা মেনে নেওয়ার মতো না।
মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাতভর ক্যাম্পাসে চলা শাখা ছাত্রলীগের সংঘর্ষের পর এখন প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে সোহানের এমন করুন অবস্থা হয়েছে? এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে সোহানের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তার সঙ্গে আলাপে সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তর তথ্য উঠে এসেছে।
সোহান মাভাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীরের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিতি। তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে তারা কয়েকজন মান্নান হলের তিনতলার ছাদে বসে ছিলেন। এমন সময় তিনতলায় হাঁটছিল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক শীলের অনুসারী সাফি, রকি, ইদ্রিস ও রুবেল। এরপরই হঠাৎ সভাপতির রুমের দিক থেকে প্রায় ৩০ জন মুখোশধারী দেশীয় অস্ত্রসহ তিনতলার ছাদের দিকে ছুটে আসেন।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোহান বলেন, ‘আমি যে পাশে ছিলাম সে পাশে তিনজন মুখোশধারী আসে। ৩০ জনের মধ্যে বাকি মুখোশধারীরা যায় অন্যদিকে। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা ছিল। এ সময় আইসিটি বিভাগের জয় ধরের মাথায় কোপ দেয় তারা। শুনেছি তার মাথায় ছয়টি সেলাই পড়েছে।’
সোহান আরও বলেন, ‘আমার দিকে আসা তিনজনের হাতে চাপাতি ও ছুরি জাতীয় ধারালো দেশীয় অস্ত্র ছিল। তারা আমার মুখের ও গলার সামনে সেগুলো ঘোরাতে থাকে। তখন মনে হয়েছে আমাকে হয়তো মেরে ফেলবে। তাই পেছনে সরতে থাকি। তখন খেয়াল ছিল না যে ছাদের কিনারায় চলে এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে আমি তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে যাই। নিচে ঢালাই করা ড্রেনের ওপর পড়ার কারণে পুরো আঘাত শরীরে লাগে। যদি মাটিতে পড়তাম, হয়তো এত ক্ষতি হতো না। আমি নিজে লাফ দিয়েছি এমনটি সত্য নয়। আমি কেন নিজে নিজে লাফ দেব? আমাকে একটা আঘাত লাগলে আমি তো মরেই যাব, এই ভেবেই আমি পিছিয়েছি।’
পরে তার বন্ধুরা এসে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) চিকিৎসাধীন আছেন।
মুখোশধারীদের চেনা যাচ্ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, তাদের পোশাক আর আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ক্যাম্পাসের নয়। অর্থাৎ তাদের হয়তো ভাড়া করে এ হামলা চালানো হয়েছে। তারা তো আমাকে মেরেও ফেলতে পারত, কারণ ক্যাম্পাসের যারা রাজনীতি করে তারা তো একটু হলেও ভয় করবে।
সভাপতির গ্রুপই এ ঘটনার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন সোহান। তিনি বলেন, ঘটনার সূত্রপাত যে বিষয়েই হোক না কেন তার সমাধান কখনো এভাবে হতে পারে না। যে কোনো ঘটনার জন্য জবাবদিহির জায়গা রয়েছে। কিন্তু এভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা মেনে নেওয়ার মতো না। তারা যদি মারতই, তবে লাঠিসোঁটা দিয়েও মারতে পারত। প্রশাসনকে বলব, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে।
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেনসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারা বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে তাকে হাসপাতালে দেখতে যান। এ সময় তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। একইসঙ্গে তার যাবতীয় দায়দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে বলেও জানান।
এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক শীল ও সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীর উভয়ই প্রশাসনের প্রতি হামলার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
এদিকে, ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট দিতে ১৪ দিনের সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বুধবার রাতে হল পরিদর্শনে গিয়ে এমনটি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন।
শাখা ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মীর মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আহত সোহানের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছে। যথাসম্ভব প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি আগামী ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন