দেশের তরুণ নাট্যকার ও পরিচালক মারুফ হোসেন সজীবের কণ্ঠে ঝরল বর্তমান অভিনয় জগতের বাস্তবতা ও হতাশার সুর। একসময় অভিনয় ছিল আত্মার অনুশীলন, মানুষের অনুভূতি আর সমাজচিন্তার দর্পণ। অথচ আজ সেটি নেমে এসেছে কেবল ভিউ, লাইক আর প্রচারের দৌড়ে। বর্তমান প্রজন্মের অভিনয় ও নির্মাণে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মানবিকতার স্পর্শ, হারাচ্ছে গভীর চিন্তার ঔজ্জ্বল্য। এই সময়ের শিল্পচর্চা নিয়ে এমন তীব্র মনোভাব ব্যক্ত করেছেন তিনি। কালবেলার সঙ্গে আলাপচারিতায় এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন এই নির্মাতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তামজিদ হোসেন।
আপনি সোশ্যাল হ্যান্ডেলের এক পোস্টে বলেছেন, ‘গাধা দিয়ে যেমন হাল চাষ হয় না, তেমনি শুধু মুখে সংলাপ আওড়ালে অভিনয়ও হয় না।’ এই কথার পেছনের ভাবনা কী?
এখন অনেকেই ভাবে, অভিনয় মানে মুখে সংলাপ বলা বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো। কিন্তু অভিনয় মানে শুধু অনুকরণ নয়, অনুধাবন। চরিত্রকে বোঝার, তার শ্বাস নেওয়ার, ব্যথা অনুভব করার একটা গভীর প্রক্রিয়া আছে। আজকের বাস্তবতায় দেখি, অনেকেই চরিত্র নয়, ক্যামেরার জন্য অভিনয় করছে। অভিনয় নয়, বরং অভিনেতা হওয়ার ভান যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে; যা আসলে খুবই ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যেতে পারে আমাদের নতুন প্রজন্মদের।
আপনি বলছেন, এখন অভিনয় কেবল একটা পোস্টে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে?
দুঃখজনকভাবে হ্যাঁ। আজকাল অভিনয় মানে অনেকের কাছে ‘শুটিং চলছে’ লেখা একটা পোস্ট। যে জানে না চরিত্রের চোখে ব্যথা ধরতে হয়, যে জানে না সংলাপের ফাঁকে নীরবতাও কত শক্তিশালী। সে ই আজ অভিনয়ের নতুন পুরোহিত। অভিনয় এখন আত্মানুসন্ধান নয়, আত্মপ্রদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন প্রজন্মের অভিনেতাদের প্রস্তুতি বা শিক্ষার জায়গায় আপনি কী সমস্যা দেখছেন
সবচেয়ে বড় সমস্যা চর্চার অভাব। অনেকে ভাবে থাকেন, পরিচালককে ঘিরে থাকলেই শেখা যায়। ভালো অভিনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা নির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে কিন্তু সে যোগাযোগটা শেখার জন্য হওয়া উচিত। কিন্তু অভিনয় শেখা মানে আমি বুঝি নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা, মানুষের হাবভাব দেখা, মুখের ভাষা বোঝা, নিজেকে আড়াল করে অন্যকে পড়া। এই জায়গাটায় খুবই শূন্যতা। আমাদের ছেলে মেয়েরা এখন সেলিম আলদিনকে চিনে না, জামিল আহম্মেদকে চিনে না। হায়রে জীবন। এখন অভিনয় শেখার জায়গায় এসেছে ভিউ শেখা, আর চরিত্রের স্থলে চান্স পাওয়ার প্রতিযোগিতা।’
আপনি নির্মাতা ও লেখকদের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন, সেখানেও কি একই সংকট?
হ্যাঁ, একদমই। এখানের সংকট আরো ভয়াবহ। একই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে নির্মাতাদের মাঝেও। অনেকে ভাবে, ক্যামেরা আর টাকা পেলেই পরিচালক হওয়া যায়। চিত্রনাট্যকার ভাবে, দু-চারটা সংলাপ লিখলেই গল্প। এদের কাছে গল্প মানে এখন ‘সিচুয়েশন’, চরিত্র নয়। ফ্রেম মানে রঙিন ছবি, আবেগ নয়।
গল্পের ভেতরের দার্শনিক বোধ, মানবিক দ্বন্দ্ব, এসব হারিয়ে গেছে তাড়াহুড়োর ভিড়ে। কি অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ দেখি আজকাল আমরা, বেক্কল সিরিজ, প্রভাসি সিরিজ। সেই ঘুরে ফিরে ভাদাইম্মার ফোর কে ভার্সন। সেই দিন বেশি দূরে নেই যেদিন আমরা আমাদের করা কাজ গুলো নিয়ে লজ্জিত হব।
এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় কী বলে মনে করেন?
‘আমাদের আবার মূল জায়গায় ফিরতে হবে, চর্চায়, ধৈর্যে ও বোঝাপড়ায়। অভিনয় বা নির্মাণ কোনো পেশা নয়, এটা একধরনের জীবনযাপন। অভিনেতা, নির্মাতা, লেখক সবাইকে চরিত্রের ভেতরে ফিরতে হবে। না হলে আমরা কেবল নিজেদের দেখাব, শিল্পকে নয়। এই সময়টা এক ভয়াবহ মজার ট্র্যাজেডি, যেখানে সবাই অভিনয় করছে, কিন্তু কেউ সত্যিকার অর্থে চরিত্রে নেই।
মন্তব্য করুন