

প্রোটিনের ঘাটতি হলে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে—যেমন শরীর ফুলে যাওয়া (edema), চুল পড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্ষুধা লাগা, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
প্রোটিন হলো শরীরের একটি মূল গঠন উপাদান। এটি পেশি, ত্বক, এনজাইম ও হরমোনের কাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যখন খাবারের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রোটিন পাওয়া যায় না, তখন শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দেয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে গুরুতর প্রোটিন ঘাটতি খুব সাধারণ নয়, তবে অনেকেই খাবারে খুব অল্প প্রোটিন নেন। এতে শরীরের প্রায় সব কার্যক্রম প্রভাবিত হতে পারে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সবচেয়ে গুরুতর প্রোটিন ঘাটতিকে বলা হয় কোয়াশিওকার (Kwashiorkor)। এটি সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, যেখানে অপুষ্টি ও ভারসাম্যহীন খাবার বেশি প্রচলিত।
হালকা প্রোটিন ঘাটতিতেও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক, প্রোটিন ঘাটতির ৮টি সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ কী কী।
শরীরের চামড়া ফুলে যাওয়া বা পাফি হয়ে যাওয়াকে এডিমা বলা হয়। এটি কোয়াশিওকারের একটি ক্লাসিক লক্ষণ।
এ অবস্থার মূল কারণ হলো অ্যালবুমিন (albumin) নামের একটি প্রোটিনের ঘাটতি, যা রক্তের তরল অংশে থাকে এবং শরীরের ফ্লুইডের ভারসাম্য রক্ষা করে।
যখন শরীরে অ্যালবুমিন কমে যায়, তখন রক্ত থেকে পানি টিস্যুতে জমে যায়, ফলে হাত-পা বা শরীরের অংশ ফুলে যায়।
এডিমা সাধারণত গুরুতর প্রোটিন ঘাটতিতে দেখা যায়, যা উন্নত দেশগুলোতে খুবই বিরল।
প্রোটিন ঘাটতির আরেকটি লক্ষণ হলো লিভারে চর্বি জমে যাওয়া, বা ফ্যাটি লিভার।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোটিনের ঘাটতি লিভারে ফ্যাট জমতে সাহায্য করে, যা পরবর্তীতে প্রদাহ, লিভার ক্ষতি বা এমনকি লিভার ফেলিওর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।
এটি কেন হয় তা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে ধারণা করা হয় যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া, কোষের শক্তিকেন্দ্র (mitochondria), ও ফ্যাট পরিবহনের প্রোটিনে পরিবর্তনের কারণে এমনটা ঘটে।
আমাদের ত্বক, চুল এবং নখ—তিনটিই মূলত প্রোটিন দিয়ে তৈরি। তাই প্রোটিনের ঘাটতি হলে এগুলোর গঠন ও বৃদ্ধিতে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, চুল সহজে পড়ে যেতে পারে বা পাতলা হয়ে যেতে পারে (Telogen Effluvium নামে পরিচিত এক অবস্থা)। শিশুদের কোয়াশিওকারে ত্বক ফেটে যাওয়া, লালচে দাগ বা ত্বকের রঙ উঠে যাওয়া দেখা যায়।
তবে এসব উপসর্গ সাধারণত গুরুতর প্রোটিন ঘাটতিতে দেখা দেয়।
আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি প্রোটিন থাকে পেশিতে। যখন খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন না থাকে, তখন শরীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর জন্য পেশি থেকে প্রোটিন টেনে নেয়, ফলে পেশি শুকিয়ে যায় বা দুর্বল হয়ে পড়ে।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে সামান্য প্রোটিন ঘাটতিও পেশি ক্ষয়ের কারণ হতে পারে।
গবেষণা অনুযায়ী, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের প্রতি পাউন্ড ওজনের জন্য কমপক্ষে ০.৫ গ্রাম প্রোটিন খাওয়া উচিত (যা সাধারণ পরামর্শের চেয়ে বেশি)। যথেষ্ট প্রোটিন খেলে সারকোপেনিয়া (Sarcopenia) নামের বয়সজনিত পেশিক্ষয় ধীর করা যায়।
কম প্রোটিন খেলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি বাড়ে।
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি প্রোটিন খান, তাদের হাড়ের ঘনত্ব (Bone Density) কম প্রোটিন খাওয়া লোকদের তুলনায় প্রায় ৬% বেশি।
পাঁচ বছর পর দেখা যায়, যাদের খাদ্যে প্রোটিন বেশি ছিল, তাদের হাড় ভাঙার ঝুঁকিও কম ছিল। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রোটিন ও হাড়ের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক পুরোপুরি বুঝতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রোটিন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যখন শিশুরা পর্যাপ্ত প্রোটিন পায় না, তখন তাদের উচ্চতা বা ওজন স্বাভাবিকভাবে বাড়ে না।
২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৪৯ মিলিয়ন শিশু বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত (stunted) হয়েছে। যেসব শিশু নিয়মিত প্রোটিন কম খায়, তাদের বৃদ্ধির সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা ৪ গুণ বেশি।
প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্যও জরুরি। প্রোটিন দিয়ে শরীর তৈরি করে অ্যান্টিবডি, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি প্রোটিন খেয়েছিলেন, তাদের সর্দি-কাশির মতো সংক্রমণ কম হয়েছে।
তবে এই সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
প্রোটিন আমাদের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যখন শরীরে প্রোটিন কমে যায়, তখন শরীর আরও খেতে ইচ্ছা করে, যেন প্রোটিন ঘাটতি পূরণ করা যায়।
কিন্তু তখন আমরা সাধারণত বেশি কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিযুক্ত খাবার খাই, যা সহজে পেট ভরায় না। ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে বেশি ক্যালরি খাওয়া হয় এবং ওজন বেড়ে যায়।
তাই যদি সবসময় ক্ষুধা লাগে, তাহলে খাদ্যতালিকায় ডিম, মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম ইত্যাদি উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার যোগ করুন।
প্রতিদিন কত প্রোটিন প্রয়োজন তা নির্ভর করে বয়স, শরীরের ওজন, কাজের ধরন এবং ফিটনেস লক্ষ্যের ওপর।
আমেরিকান ডায়েটারি গাইডলাইন (২০২0-২০২৫) অনুযায়ী: প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের প্রয়োজন প্রতিদিন প্রায় ৪৬ গ্রাম প্রোটিন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের জন্য ৫২-৫৬ গ্রাম প্রোটিন।
এটি গড়ে শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ০.৮ গ্রাম প্রোটিন হিসেবে ধরা হয়।
তবে এটি শুধু শরীরের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য ন্যূনতম পরিমাণ। যদি আপনি পেশি বাড়াতে চান, তাহলে প্রতি কেজিতে ১.৪-২ গ্রাম প্রোটিন খাওয়া উচিত। অ্যাথলেট বা যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের জন্য প্রয়োজনে আরও বেশি প্রোটিন (প্রতি কেজিতে প্রায় ৩ গ্রাম পর্যন্ত) উপকারী হতে পারে।
প্রোটিন আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ—ত্বক, পেশি, চুল, হাড়, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্যও। তাই প্রতিদিনের খাবারে ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, ডাল, বাদাম, টোফু বা ওটসের মতো প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখুন। এটি শুধু শরীরকে শক্তিশালী রাখে না, দীর্ঘমেয়াদি অনেক রোগ থেকেও সুরক্ষা দেয়।
সূত্র: হেলথলাইন
মন্তব্য করুন