

অনেক ধরনের খাবার ও পানীয় আছে যেগুলো লিভারের যত্ন নিতে সাহায্য করে। যেমন— ওটমিল (oatmeal), গ্রিন টি, বেরি ফল, অলিভ অয়েল এবং রসুন।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত, লবণাক্ত এবং মিষ্টি খাবারগুলো লিভারের জন্য হজম করা কঠিন হয়। লিভারের স্বাস্থ্য আমাদের সামগ্রিক শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি লিভার অসুস্থ হয়ে যায়, তাহলে তা লিভারের রোগ বা বিপাকজনিত (metabolic) সমস্যার কারণ হতে পারে।
যদিও সব ঝুঁকির কারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু নির্দিষ্ট খাবার ও পানীয় গ্রহণ করলে লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আজকের এই লেখায় এমন কিছু খাবারের কথা বলা হয়েছে, যেগুলো লিভারের জন্য উপকারী এবং কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলা ভালো।
নীচে এমন কিছু খাবার ও পানীয়ের কথা বলা হলো, যেগুলো লিভারের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
২০২১ সালের একটি গবেষণায় যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪,৯৪,৫৮৫ জন মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের কফি (ডিক্যাফ, ইনস্ট্যান্ট, গ্রাউন্ড ইত্যাদি) নিয়মিত পান করলে দীর্ঘমেয়াদি লিভারের রোগের ঝুঁকি কমে।
এর মধ্যে গ্রাউন্ড কফির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।
গবেষকরা পরামর্শ দেন, দিনে ৩-৪ কাপ কফি পান করলে লিভারের জন্য সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যায়। কফির উপকারিতা একাধিক সক্রিয় উপাদান থেকে আসে বলেও ধারণা করা হয়।
আরও এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কফি পান করলে লিভার শক্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে এবং লিভারের এনজাইমের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে—এমনকি যাদের লিভারের সমস্যা নেই, তাদেরও উপকার পেতে পারে।
ওটমিল খাওয়া সহজ এবং এতে প্রচুর ফাইবার থাকে, যা হজমে সাহায্য করে। ওটসে থাকা বিশেষ ধরনের ফাইবার, যাকে বিটা-গ্লুকান (beta-glucan) বলা হয়, লিভারের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিটা-গ্লুকান শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, প্রদাহ কমায়, এবং ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি হ্রাস করে।
প্রাণী-পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটি লিভারে জমে থাকা চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
তবে মানুষের ক্ষেত্রে এ প্রভাব নিশ্চিত করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। ওটমিল খেতে চাইলে পুরো দানা ওট বা স্টিল-কাট ওট বেছে নেওয়া ভালো— ইনস্ট্যান্ট ওটমিলে প্রায়ই অতিরিক্ত চিনি বা ময়দা মেশানো থাকে, যা শরীরের জন্য তেমন উপকারী নয়।
২০২০ সালের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পরিমিত পরিমাণে গ্রিন টি পান করলে ALT ও AST নামে দুটি লিভার এনজাইমের মাত্রা কমে, যেগুলো সাধারণত লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে বেড়ে যায়।
তবে খুব বেশি পরিমাণে গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট নিলে কখনো কখনো লিভারের এনজাইম বেড়ে যেতে পারে বা হালকা লিভার ইনজুরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পান করা বন্ধ করলে সাধারণত লিভার আবার সুস্থ হয়ে যায়।
যাদের নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার (NAFLD) আছে, তাদের জন্য পরিমিত গ্রিন টি উপকারী হতে পারে, তবে যাদের লিভার একেবারে স্বাভাবিক, তাদের ক্ষেত্রে এটি এনজাইম সামান্য বাড়াতে পারে।
২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মি.গ্রা. রসুন গুঁড়া খেলে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার আক্রান্তদের লিভারে জমে থাকা চর্বি ও অন্যান্য ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়।
চীনে ২০১৯ সালের এক গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কাঁচা রসুন খেলে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বিষয়ে আরও গবেষণা দরকার।
গাঢ় রঙের বেরিগুলোতে পলিফেনল নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
বিভিন্ন প্রাণী-গবেষণায় দেখা গেছে, ব্লুবেরি ও ক্র্যানবেরির উপাদান লিভার ক্ষতি, প্রদাহ ও চর্বি জমা কমায়।
তবে মানুষের শরীরে একই প্রভাব আছে কি না তা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, আঙুরের খোসা ও বিচির উপাদান লিভার বড় হয়ে যাওয়া, প্রদাহ ও চর্বি জমা কমাতে সাহায্য করে।
সম্পূর্ণ বিচিওয়ালা আঙুর খাওয়া বা grape seed extract গ্রহণ করলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়।
গ্রেপফ্রুটে দুটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে—নারিনজিন (naringin) ও নারিনজেনিন (naringenin)।
এগুলো লিভারে প্রদাহ কমায় এবং কোষকে রক্ষা করে।
তবে কিছু ওষুধের সঙ্গে গ্রেপফ্রুটের বিক্রিয়া হতে পারে, তাই এটি খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
এই ক্যাকটাস-জাতীয় ফল ও এর রস লিভারের জন্য উপকারী হতে পারে। প্রাণী-গবেষণায় দেখা গেছে, এটি লিভারকে রক্ষা করে এবং প্রদাহ কমায়।
তবে মানুষের ক্ষেত্রে এর সঠিক পরিমাণ ও প্রভাব জানতে আরও গবেষণা দরকার।
২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্ভিদ-ভিত্তিক ডায়েট অনুসরণ করলে লিভারে চর্বি জমা ও NAFLD-এর ঝুঁকি কমে। এই খাবারগুলোর মধ্যে আছে—
- সম্পূর্ণ শস্য (যেমন ব্রাউন রাইস, হোল হুইট ব্রেড, কুসকুস)
- শাকসবজি (গাজর, ব্রকলি, লেটুস)
- বাদাম
- মটরশুটি, শিমজাতীয় খাবার ইত্যাদি।
এগুলো সুষম খাদ্যাভ্যাসের অংশ হিসেবে খাওয়া সবচেয়ে ভালো।
স্যামন, সার্ডিন বা টুনা মাছের মতো চর্বিযুক্ত মাছ ও ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্টে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড লিভারের প্রদাহ কমায় এবং ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
নিয়মিত ফিশ অয়েল গ্রহণ করলে লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকিও কমে যেতে পারে।
বাদামে থাকে স্বাস্থ্যকর চর্বি, ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট—যেগুলো লিভারের প্রদাহ ও চর্বি জমা কমাতে সাহায্য করে।
নিয়মিত বাদাম খাওয়া লিভারকে সুস্থ রাখার সহজ উপায়গুলোর একটি।
অতিরিক্ত চর্বি লিভারের ক্ষতি করতে পারে, তবে অলিভ অয়েল এর ব্যতিক্রম। এতে থাকা অসংপৃক্ত চর্বি (unsaturated fats) লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়।
তবে এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, বিশেষ করে যাদের ইতিমধ্যেই NAFLD আছে।
লিভারের সুস্থতার জন্য সুষম খাদ্য প্রয়োজন, কিন্তু কিছু খাবার লিভারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যেমন—
তেল-চর্বিযুক্ত খাবার: ভাজা খাবার, ফাস্টফুড, প্যাকেটজাত স্ন্যাকস বা চিপস।
স্টার্চি খাবার: প্রক্রিয়াজাত পাউরুটি, পাস্তা, কেক, বেকারি পণ্য।
চিনি: অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার, সিরিয়াল, পেস্ট্রি বা ক্যান্ডি কমানো ভালো।
লবণ: খুব বেশি লবণ খাওয়া লিভারের উপর চাপ ফেলে। কম লবণযুক্ত খাবার বেছে নেওয়া উচিত।
অ্যালকোহল: লিভার বিশ্রাম দিতে চাইলে অ্যালকোহল কমাতে বা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
সূত্র: হেলথলাইন
মন্তব্য করুন