

বিশ্বজুড়ে প্রায়ই খবর পাওয়া যায় ভূমিকম্প, ধস বা দুর্ঘটনায় কেউ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে দিন দশেক পরও জীবিত উদ্ধার হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, একেবারে খাবার ও পানি ছাড়াই কি মানুষ এত দিন বেঁচে থাকতে পারে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিষয়টি নির্ভর করে নানা উপাদানের ওপর—ব্যক্তির বয়স, ওজন, শারীরিক অবস্থা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, পরিবেশের তাপমাত্রা, দেহে চর্বি ও পানির পরিমাণ ইত্যাদি। তবে না খেয়ে ঠিক কতদিন বেঁচে থাকা যায়, সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট গবেষণা নেই। কারণ, কাউকে দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, অনশন বা ধর্মঘটের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা দেন, খাবার ও পানি দুটোই বন্ধ থাকলে মানুষ সাধারণত ৮ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। আর খাবার ছাড়া শুধু পানি খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত।
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের তথ্যমতে, খাবার ও পানি ছাড়া গড়ে ৮-২১ দিন পর্যন্ত টিকে থাকা সম্ভব। আর শুধু খাবার না খেলে গড়ে প্রায় দুই মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকা যায়, যদিও এটি বয়স ও স্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এ অনুমানটি নেওয়া হয়েছে এক ৮১ বছর বয়সী ব্যক্তির বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে।
অন্যদিকে ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক অনশন বা ধর্মঘটে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৫ থেকে ৬১ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার নজির রয়েছে। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় আরও জানা যায়, যার বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ১৮.৫–এর নিচে, তার গড় আয়ু স্বাভাবিক ওজনের মানুষের তুলনায় প্রায় ৪ বছর কম। অর্থাৎ দেহের গঠন, বয়স ও ওজন—সবকিছুই না খেয়ে বেঁচে থাকার সময় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।
না খেয়েও কীভাবে টিকে থাকা সম্ভব
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবার না পেলে শরীর প্রথমে সঞ্চিত গ্লুকোজ ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করে। একদিন পর সেই মজুদ ফুরিয়ে গেলে লিভার ও পেশির গ্লাইকোজেন ভেঙে শক্তি তৈরি হয়। দুই দিনের মধ্যে এই মজুদও শেষ হয়ে গেলে শরীর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেশি ভাঙা শুরু করে। তবে শরীর তখনও টিকে থাকতে চায়, তাই দ্রুত ফ্যাট (চর্বি) ভেঙে কেটোন তৈরি করে শক্তি জোগায় এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় কিটোসিস।
এই কারণেই স্থূল বা মোটা মানুষ সাধারণত রোগা মানুষের চেয়ে বেশি দিন না খেয়েও টিকে থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম ৫ দিনে প্রতিদিন ১-২ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে যেতে পারে, যার বেশিভাগই পানি ও ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতির কারণে। কয়েক সপ্তাহ পর এই ওজন কমার গতি কমে গিয়ে দিনে প্রায় ০.৩ কেজি হয়। যাদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি, তারা তুলনামূলক বেশি দিন বাঁচতে পারেন। কিন্তু একসময় যখন ফ্যাটও ফুরিয়ে যায়, শরীর আবার পেশি ভাঙা শুরু করে—যেখান থেকে মৃত্যু অনিবার্য হয়ে ওঠে।
পানি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
পানি ছাড়া টিকে থাকা অনেক কঠিন। যথেষ্ট পানি না পেলে কিডনির কার্যক্ষমতা কয়েক দিনের মধ্যেই নষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, কেউ যদি প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় লিটার পানি পান করেন এবং তার সঙ্গে অল্প লবণ (প্রায় আধা চা-চামচ) মিশিয়ে নেন, তাহলে তিনি অনাহারে থেকেও তুলনামূলক বেশি সময় বাঁচতে পারেন।
দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকলে দেহে কী কী সমস্যা হয়?
দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকার ফলে ধীরে ধীরে দেহের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে। রাজ্যের অবসাদ আর ক্লান্তি ভর করে বসে দেহে। হৃৎপিণ্ড চালু রাখার পর্যাপ্ত শক্তিও থাকে না আর। রক্তচাপ ও নাড়ির গতিও তাই কমে যায়। পাকস্থলীতে খাদ্যের অভাব বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি করে।
এ ছাড়া শুষ্ক ত্বক, চুল পড়া, অস্থি ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া কিংবা মেয়েদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়ার মতো হরমোনঘটিত সমস্যাও দেখা যায়। প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্মেও যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে।
শেষ কথা
মানবদেহ আশ্চর্য সহনশীল হলেও তা কখনোই সীমাহীন নয়। খাবার ও পানির অভাবে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত টিকে থাকা সম্ভব হলেও এটি জীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকা মৃত্যু-ঝুঁকি বাড়ায় এবং দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুতরাং, অনাহার কোনো সমাধান নয়, বরং এটি জীবনের জন্য ভয়াবহ হুমকি।
সূত্র : হেল্থ লাইন, এনআইএইচ ও মেডিসিন নেট
মন্তব্য করুন