সাদা মার্বেল বাঁধানো কাঠের টেবিল। পুরোনো দিনের কাঠের চেয়ার। টেবিলে কলাপাতার পাত রাখা আছে। সঙ্গে মাটির পাত্রে খাওয়ার পানি। দেওয়ালে পুরোনো রঙের প্রলেপ। সেখানে একের পর এক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি সযত্নে টাঙানো। কোথাও সুভাষচন্দ্র বসু, কোথাও অরবিন্দ ঘোষ। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।
শহরে বুকে বাঙালি ঘরোয়া খাবারের এক চিলতে ঠিকানা এই পাইস হোটেল। নাম ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’। স্বাধীনতার আগে যার নাম ছিল ‘হিন্দু হোটেল’। ৮/২ ভবানী দত্ত লেন, কলকাতা ৭৩, ওড়িশার কটক থেকে চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসা এক সদ্য যুবা মনগোবিন্দ পণ্ডা এই ঠিকানায় খুলেছিলেন ভাতের হোটেল।
কলকাতায় পাইস হোটেল নতুন কিছু নয়। আদিকাল থেকে আছে। আজও শহরের বিভিন্ন ফাঁকফোকর, অলিগলিতে দেখা যায়। কিন্তু শহরের আর পাঁচটা পাইস হোটেলের চেয়ে ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’ কিছুটা আলাদা। ৮/২ ভবানী দত্ত লেনের স্বল্প পরিসর হোটেলে ঢুকলে কোর্মা-কালিয়ার সুবাস ছাড়াও আরও একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তা হল পুরোনো কলকাতার ঘ্রাণ। শোনা যায়, এই হোটেলে ছাত্রজীবনে খেতে আসতেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র! হোটেলের পাশেই হিন্দু কলেজের (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র ছিলেন তিনি। জিভে পানি আনা পুঁই চচ্চড়ির টানে। কলেজের পাট চুকিয়ে ফেলার পরেও না কি যার মায়া ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। পুঁইশাকের সেই চচ্চড়ি এখনও এখানকার ‘হিট’ রান্না। মেনু কার্ডে পনেরো রকমের মাছ থাকলেও পুঁইশাকের স্বাদ দেখা চাই-ই।
১৯১১ সালে ওড়িশার প্রান্তিক অঞ্চল থেকে কলকাতা এসেছিলেন মনোগোবিন্দ। বাঙালির জীবনে ১৯১১-র বাড়তি গুরুত্ব আছে। ১৯১১-তেই ফুটবল মাঠে মোহনবাগানের গোরা-বধ। মনে করা হয়, ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে সেই শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের হারানো দেশজুড়ে চলা স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন উপাখ্যান লিখেছিল। মনোগোবিন্দ তখন আবার অন্য সংগ্রামে ডুবে। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দুমুঠো ভাতের জন্য সংগ্রাম। বিনিদ্র রাত কাটত, অভুক্ত পেটে ঘুমিয়ে পড়তে হতো। কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যু ঘটতে দেননি তিনি। আর কিছু যে ছিল না তার। স্বপ্ন আর জেদ ছাড়া। পরিকল্পনা আসত মাথায়, পেটে দানাপানি না পড়লে আরও বেশি করে আসত। কিন্তু পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার সুযোগ পেতেন না। প্রায় বছরখানেক চলে মনগোবিন্দের এই দুর্বিষহ লড়াই। তার পর এক চিলতে জমি জোগাড় করেন, খুলে ফেলেন ‘হিন্দু হোটেল।’
বহু যুগ পেরিয়েছে তার পর। গঙ্গা দিয়ে প্রচুর জল বয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ গিয়েছে। কলকাতা বদলেছে। বদলেছে মানুষজন, পাল্টেছে রুচি। কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল’। মনোগোবিন্দের মৃত্যুর পর তার ভাই প্রহ্লাদ পণ্ডার হাতে হোটেলের মালিকানা যায়। ইটের গাথুঁনি থেকে খাদ্যতালিকা, কিছুই বদলাতে যাননি তিনি। তবু প্রজন্ম আসে, প্রজন্ম যায়। ৯০ বসন্ত পার করে তিনিও গত হয়েছেন। পাইস হোটেলের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রহ্লাদের পুত্র অরুণাংশু পণ্ডা। তিনিও অবশ্য পরিবর্তনের পক্ষে নন। নিজে পাকা ব্যবসায়ী হলেও পারিবারিক ঐতিহ্য নিয়ে ছেলেখেলা করতে চাননি।
মনোগোবিন্দ ব্যবসা অত ভালো বুঝতেন না। লোকে ঠিক করে খেল কি না, খেয়ে তৃপ্তি পেল কি না, তিনি শুধু সেটা দেখতেন। অরুণাংশু ব্যবসা বোঝেন। কিন্তু আবেগ, ঐতিহ্য মুছে যেতে দেননি। আজও তা অক্ষয় রয়েছে একইভাবে। প্রতিদিন প্রায় দেড়শো থেকে দুশো জনের রান্না হয় হোটেলের রান্না ঘরে। মনোগোবিন্দের আমলের মতো এখনও সমস্ত রান্না হয় কয়লার উনুনে। কৃত্রিম তেল নয়, রান্নায় দেওয়া হয় ঘানির সরিষার তেল। যার ঝাঁঝে চোখে জল আসে। ‘পণ্ডা অ্যান্ড সন্স’ বিশ্বাস করেন, রান্নায় স্বাদ আসে মশলার গুণে। তাই বাজারের গুঁড়ো মসলা নয়, দেওয়া হয় বাটা মসলা। মৌরলা মাছের ঝাল থেকে বাঁধাকপির তরকারি, সব কিছুতে।
আর খাবার? তার স্বাদ? শহরের যে কোনো অভিজাত বাঙালি রেস্তোরাঁর ‘ফাইন ডাইনিং’-কে লজ্জায় ফেলতে যথেষ্ট। পার্শের ঝাল, ট্যাংরার ঝাল, চিতল কোরমা, চিংড়ির মালাইকারি, পমফ্রেটের ঝাল, ভেটকি, দই কাতলা, আড় কালিয়া, তোপসে ফ্রাই— মাছের পদই রয়েছে ১৫-১৬ রকম। তা ছাড়া, মুসুর ডাল, ভাজাভুজি, খাসির মাংস, মুরগি কষা, ডিমের বড়া আর শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— শেষ পাতে কাঁচা আমের চাটনি তো রয়েছেই। বাহ্যিক কোনো চাকচিক্য নেই, হোটেলে বাহারি আলোর ঝলকানি নেই, বিশেষ কোনো প্রচার নেই। তবু রোজ-রোজ মানুষ যে এখানে ছুটে আসেন, তা কিসের টানে?
‘খাবারের টানে, খাবারের স্বাদের টানে,’ বলেন অরুণাংশু। ‘আমাদের হোটেলে একবার যারা খেয়ে যান, তাদের ফিরে আবার আসতে হয়,’ ফের বলেন তিনি। অনেকে তো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে খাবার নিয়েও যান বাড়িতে। সুইগি, জোম্যাটোর যুগে যখন কিনা লোকের দুদণ্ড দাঁড়ানোর সময় নেই, তখন কলেজ স্ট্রিটের তস্য গলির মধ্যে এক খাবারের দোকানে লোকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে, ভাবলে অবাক লাগে না? অরুণাংশুর কথায়, ‘তা-ও তো দূরের অনেকেই মাঝেমাঝে আক্ষেপ করেন। তারা আমাকে বলেছেন, সুইগি, জোম্যাটোর সঙ্গে একটা গাঁটছড়া বেঁধে নিতে। যাতে বালিগঞ্জ, নিউ টাউন, গড়িয়াতে বসেও হিন্দু হোটেলের খাবার চেখে দেখা যায়। তবে আমরা এখনও এত কিছু ভাবিনি। আগে হোটেলে সকলে পিঁড়িতে বসে খেতেন। এখন কাঠের চেয়ার-টেবিল। যতটুকু না বদলালে নয়, ঠিক ততটাই বদলেছে। বাড়তি কিছু করতে চাইছি না এখনই।’
বদলাবেনও বা কেন? ঐতিহাসিক জিনিসে কখনও কেউ হাত দেয়? স্বাধীনতা পূর্ব আমলে এই পাইস হোটেল হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আখড়া। সুভাষচন্দ্র তো আসতেনই, এখানে পায়ের ছাপ রয়েছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষেরও। গুপ্ত আলোচনা চলত, সঙ্গে খাওয়াদাওয়া। মনোগোবিন্দ এবং তার ছোট ভাই প্রহ্লাদ পণ্ডা অবাক হয়ে শুনতেন সে সব কথোপকথন। এখনও প্রতি বছর আগস্ট মাসের ১৫ তারিখে হোটেলে উৎসব হয়। স্বাধীনতার উৎসব। হেঁশেলের রকমারি রান্নার সুবাস তখন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বইপাড়ায়। ধুমধাম করে পালন হয় সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনও। সে দিন হোটেলে প্রথম একশোজনকে খাওয়ানো হয় একেবারে বিনা টাকায়। নামিদামি রেস্তোরাঁ আর কফিশপের কৃত্রিমতায় ভরা শহরে যা ভাবাই যায় না। ৮/২ ভবানী দত্ত লেন যে শুধুই বাঙালির ভোজনবিলাসের ঠিকানা নয়। এ তো চলমান ইতিহাসের ঠিকানাও।
মন্তব্য করুন