চিঠি লেখেননি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেউ লিখেছেন পরীক্ষার খাতায় আবার কেউবা লিখেছেন প্রিয় মানুষকে। যদিও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে চিঠি যেন কেবল এক হারিয়ে যাওয়া শব্দ, ইতিহাসের ধুলোমাখা অধ্যায়, এক ভুলে যাওয়া রীতির নাম। অথচ একসময় চিঠি ছিল জীবনভর সংরক্ষণ করার মতো ধন। সাদা কাগজের পাতায় কালি-লেখা অক্ষরই ছিল প্রেম-ভালোবাসার প্রকাশ, বিরহের বেদনা কিংবা পরিবারের খবরের একমাত্র বাহন। ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টা শুনলেই অজান্তে বুক ধড়ফড় করত, চোখ ছুটে যেত দরজার দিকে। হয়তো একটা কাগজের টুকরো এসে বদলে দিত কারও পুরো দিনের মনখারাপ।
শেষ কবে চিঠি লিখেছেন বা পেয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনেকেই এখন আর দিতে পারবে না। প্রযুক্তির কল্যাণেই চিঠি লেখার শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঘোড়ার ডাক প্রচলনের আগে কীভাবে চিঠি আদান-প্রদান হতো, তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও আজকাল দাপ্তরিক কাজের নথি বা আবেদনপত্র ছাড়া কেউ ডাকঘরে যে যায় না, সেটা সবারই জানা।
চিঠি মানেই শুধু খবর আদান-প্রদান নয়; বরং এক অদৃশ্য আবেগের বাহন ছিল চিঠি। চিঠির কাগজে লেগে থাকত প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ, অক্ষরে যেন মিশে থাকত তার হৃদয়ের কাঁপন। প্রেমিকার রাগভরা এক লাইন পড়ে মনে হতো যেন সে সামনেই বসে আছে। দূরদেশে থাকা সন্তানের লেখা আক্ষেপভরা চিঠি মায়ের বুকের ভেতর হাহাকার তুলত। আবার বাবার উপদেশভরা চিঠি পড়তে পড়তে মনে হতো যেন কানে বাজছে গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর।
তবে চিঠি নিয়ে আজ এত কথা কেন? কারণ আজ আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস। আজ না হয় চিঠি দিবসকে কেন্দ্র করে কাগজ-কলমে আপনজনকে মনের কথাগুলো চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারেন। আজকের প্রজন্ম হয়তো কল্পনাই করতে পারে না, একেকটা চিঠির জন্য মানুষ কীভাবে দিন গুনত। প্রবাসী স্বামীর চিঠি আসবে ভেবে স্ত্রী সারাদিন চৌকাঠে বসে থাকতেন। ছেলের খবর জানার জন্য বুড়ো বাবা ডাকপিয়নের পায়ের শব্দে দরজা খুলে দাঁড়াতেন। আর এক টুকরো কাগজ হাতে পেলেই বুক ভরে উঠত আনন্দে, আবার চোখ ঝাপসা হয়ে যেত কান্নায়।
কিন্তু সময় বদলেছে। আবেগও বদলে গেছে। আজ সবকিছু হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে, ইন্টারনেটের গতিতে। কথা বলতে আর দিন-রাত অপেক্ষা করতে হয় না, মুহূর্তেই ভিডিও কলে মুখ দেখা যায়। আনন্দ কিংবা দুঃখ প্রকাশ করতে আজ আর কাগজে কলম লাগে না। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক যোগাযোগে হারিয়ে গেছে অপেক্ষার সৌন্দর্য, হারিয়ে গেছে আবেগের গভীরতা।
চিঠির সেই দমবন্ধ করা অপেক্ষা, পড়তে পড়তে কল্পনায় ডুবে যাওয়া এসব আর এখন নেই। এখন কাউকে না দেখেই তার লেখা পড়ে মুহূর্তে সেই মানুষকে চোখের সামনে কল্পনা করার আনন্দ নেই। প্রিয় মানুষের হাতে লেখা অক্ষরে যে কাঁপন থাকত, যে আবেগ ভেসে উঠত, মোবাইলের কি-বোর্ডে তা ধরা পড়ে না। মেসেঞ্জারের ইনবক্সে ভালোবাসার বার্তা হয়তো হাজার হাজার; কিন্তু তার কোনোটিই হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, যেমনটা ছুঁয়ে যেত একটি চিঠি।
চিঠি মানেই ছিল অপেক্ষার আনন্দ। ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকা, ভাঁজ খোলা মাত্র কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়া, প্রিয়জনের লেখা পড়তে পড়তে অশ্রু ঝরে পড়া, এসব এখন অনেকের কাছে কেবলই রূপকথা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো চিঠি কেবলই ‘স্লো’ এক মাধ্যম। কিন্তু যারা চিঠির সময়ের ভেতর দিয়ে বেঁচে উঠেছে, তাদের কাছে এটি ছিল এক টুকরো উন্মাদনা। প্রিয় মানুষের চিঠি বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়ার অনুভূতি, অথবা অভিমানভরা কয়েকটি শব্দে সারারাত জেগে থাকার যন্ত্রণা সেই অনুভূতি আসলে যারা বাস্তবিক ছিল তাদের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যাওয়ার নয়।
চিঠি ছিল আসলে এক টুকরো ইতিহাস। ভালোবাসা, বিরহ, অভিমান, আক্ষেপ সবকিছুর সাক্ষী হয়ে সেই কাগজগুলো থেকে গেছে অনেকের পুরোনো ঘরে, ট্রাঙ্কের কোণে কিংবা বইয়ের ভাঁজে। প্রযুক্তি হয়তো আমাদের জীবন সহজ করেছে; কিন্তু কাগজে লেখা সেই হাতের ছোঁয়া, সেই অপেক্ষার আবেগ আর সেই কল্পনার ডুব এসব কেড়ে নিয়েছে।
প্রতিবছর আজকের (১ সেপ্টেম্বর) এই দিনে পালিত হয়ে আসছে ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’। এই দিবসের শুরু ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি দেশের বড় ব্যক্তিত্বদের চিঠি পাঠাতেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি সেসব চিঠির উত্তর পেতেন না। আর যখন কোনো চিঠির উত্তর পেতেন, তখন তার আনন্দের সীমা থাকত না। সেই ভালোবাসা থেকে সিম্পকিন ২০১৪ সালে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন চিঠি লেখার চর্চা আবার ফিরে আসুক।
মন্তব্য করুন