পৃথিবীর ইতিহাসে ঠেলাগাড়ি হচ্ছে ঠেলে ঠেলে চালানোর এক ধরনের যান। চাকা আবিষ্কারের পর যেসব যান মানুষের জীবন যাত্রা সহজীকরণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল তার মধ্যে ঠেলাগাড়ি অন্যতম। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত একটি অঞ্চল ককেশাস। এর উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩ হাজার ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ঠেলাগাড়িতে বহন করে মরদেহ কবরস্থানে এনে কবর দেওয়া হয়েছে।
সারা বিশ্বে এক-দুই-তিন-চার চাকার বিভিন্ন ধরনের ঠেলাগাড়ি থাকলেও আমাদের দেশে বর্তমানে ঠেলাগাড়ি বলতে দুই চাকার ওপরে বাঁশের পাটাতনবিশিষ্ট বিশেষ ধরনের মালবাহী বাহনকেই চিনি। মূলত এই বাহন দিয়ে বাসাবাড়ির মালপত্র আনা-নেওয়া, স্বল্প দূরত্বে ভারী জিনিসপত্র যেমন—খাদ্যদ্রব্যের বস্তা, সিমেন্টের বস্তা, রড, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ভারী লোহার জিনিসপত্র এবং সবজি বা ফল, যেমন—নারকেল, তরমুজ, কাঁঠাল, বাঙ্গি প্রভৃতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশে বর্তমান সময় মালবাহী দেশি এ ধরনের ঠেলাগাড়িতে সাধারণত একজন চালক এবং দুজন সহকারী থাকেন। চালকের কাজ হচ্ছে গাড়ি ঠেলার পাশাপাশি দিকনির্দেশনা ও গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং হাঁকডাকের মাধ্যমে রাস্তার পথযাত্রীদের সাবধান করা। অন্যদিকে সহকারীদের দায়িত্ব হচ্ছে চালকের কথামতো ঠেলাগাড়ি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া এবং চালককে সহযোগিতা করা।
ঢাকায় এক দশক আগেও ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবন নির্বাহ করত প্রায় দুই তিন হাজার খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের অধিকাংশ বংশাল, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী থেকে পণ্য আনা-নেওয়া করেন বলে জানা যায় ।
বর্তমানে দেশে ঠেলাগাড়ি বিলুপ্তির পথে। মোটরচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক, শ্যালো মেশিনের ট্রলি, মিনিট্রাক দখল করে নিয়েছে ঠেলাগাড়ির জায়গা। ফলে জীবন-জীবিকার তাগিদে ঠেলাগাড়ি চালানোর পেশায় নিয়োজিত মানুষ এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। কারণ, এখন সবাই তাড়াতাড়ি কাজ সারতে চায়। ঠেলাগাড়ির চেয়ে দ্রুত চলাচল করে ইজি বাইক, শ্যালো মেশিনের ট্রলি, মিনি পিকআপ ও মোটরচালিত ভ্যান। কম সময় লাগে বলে অনেকেই এখন ঠেলাগাড়ির প্রতি অনীহা দেখায়। তাই বাধ্য হয়ে অনেক ঠেলাগাড়ির চালক ঠেলাগাড়ির পরিবর্তে ওই সব বাহন কিনে ব্যবসা শুরু করেন।
পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় আসা ঠেলাগাড়ির চালক সেলিম মাতুব্বরের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি আমাকে বলেন, উন্নত প্রযুক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের যেমন সামনের দিকে অগ্রসর হতে সুবিধা করে দিয়েছে, তেমনি কেড়েও নিয়েছে আমাদের অনেক কিছু। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের পরিশ্রম কমেছে, একইভাবে কর্মসংস্থানও কমেছে। ফলে এক দশক আগের পেশাও পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে আমাদের মধ্যে অনেকে। ঠেলাগাড়ি ঠেলে আমার যা আয় হয় এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে আমাদের স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্ট। আধুনিক মোটর যানের ব্যবহারের ফলে আমাদের চাহিদা কমেছে তবে আমরা ছোট পিকআপ বা ইঞ্জিনচালিত ভ্যান থেকে কম পরিবহন খরচে গ্রাহকের সমপরিমাণ পণ্য পৌঁছে দিচ্ছি।
আরেক ঠেলাগাড়ি চালক রশীদ আমাকে বলেছিলেন, তাদের পেশার কোনো নিরাপত্তা নেই। আজ টিপ আছে কাল নেই। তারা যারা ঢাকা মহানগরে ঠেলাগাড়ি চালান তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। প্রায় প্রতিদিনই তাদের কেউ না কেউ সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হন। তাদের দেখার কেউ নেই।
এ চালকের ভাষ্য, বাসাবাড়ির মালামালা আনা-নেওয়া, স্বল্প দূরত্বে ভারী জিনিসপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম বাহন ঠেলাগাড়ি। সময়সাপেক্ষ হলেও কয়েক বছর আগেও এ বাহনটির বহুল প্রচলন ছিল খুলনায়। কিন্তু সেই ঠেলাগাড়িই এখন বিলুপ্তির পথে। মোটরচালিত ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, স্যালোমেশিনচালিত ট্রলি, মিনি ট্রাক দখল করে নিয়েছে ঠেলাগাড়ির জায়গা। ফলে জীবন-জীবিকার তাগিদে ঠেলাগাড়ি চালানোর পেশায় নিয়োজিত ঢাকায় কয়েক হাজার মানুষ এখন পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
ঠেলাগাড়ি চালকের সহযোগী চান্দু মিয়ার আক্ষেপ ছিল তুঙ্গে। পরিস্থিতি আরেকটু ভালোভাবে বুঝতে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়। তার ভাষ্য, এই ঠেলা গাড়ি ঠেলে আর জীবন চলছে না, সংসারের খরচ বাড়ছে। খাবার খরচ দিন দিন বাড়ছে। আমরা প্রতিদিন এক দুইটা টিপ পাই। আবার কোনো দিন একটাও পাই না। আমাদের কাজের নিরাপত্তা নেই।
এই ঠেলাগাড়ির ফলে খরচ তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে বলে সিদ্দিক বাজারের স্যানিটারি পণ্য ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইমন মনে করেন। তিনি বলেন, এই ঠেলাগাড়ির ফলে আমরা দুই-তিন হাজার টাকায় পণ্য পৌঁছে দিতে পারছি। অথচ পিকআপ চার-পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া লাগতো। এতে করে আমাদের ও গ্রাহকের খরচ সাশ্রয় হচ্ছে।
ঢাকার গুলিস্তান, নয়াবাজার, বংশাল, সায়দাবাদ, এলাকায় এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ ঠেলাগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা নিয়মিত এখানকার পণ্যপরিবহনকারী এজেন্সিগুলোর পণ্য বিভিন্ন দোকান থেকে এজেন্সিগুলোর অফিসে নিয়ে আসেন। এই জন্য তারা ঠেলাগাড়ি প্রতি ১০০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত প্রকারভেদে পেয়ে থাকেন যা চালক ও সহকারী দুই-তিনজন ভাগ করে পান।সাধারণত সহকারীরা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ও চালক ৪০০-৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন। এখানকার অধিকাংশ ঠেলাগাড়ির চালক নিজেদের ঠেলাগাড়ি চালান। তাদের পেশা যত বদল হবে তত অন্য পেশায় কিছুটা হলেও চাপ পড়বে।
মন্তব্য করুন