গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শনিবার (৫ জুলাই) রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে অনুষ্ঠিত ‘গণমাধ্যম সংস্কার প্রতিবেদন পর্যালোচনা’ এক সেমিনারে এ কথা জানান।
তিনি জানান, সাংবাদিকতা এক সময় অনেক বেশি সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমরা একটি মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইছি।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব আরও জানান, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে নতুন যে আইন এসেছে, তা কোনোভাবেই প্রেস ফ্রিডমে হস্তক্ষেপ করে না। ভুল সংবাদ হলে তা বলার আলাদা উপায় রয়েছে, হুমকি বা গুমের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসাই লক্ষ্য।
তিনি আরও বলেন, প্রেস ফ্রিডম মানে মিথ্যা বলার গ্যারান্টি নয়। যে ব্যক্তি মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, তাকে প্ল্যাটফর্ম দেওয়া উচিত নয়।
এ সময় সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতনের বিষয়ে সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন প্রেস সচিব। ওয়েজ বোর্ড জটিলতায় না গিয়ে বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করার আহ্বান জানান তিনি। পশাপাশি প্রত্যেক মিডিয়া হাউজের সোশ্যাল মিডিয়া নীতিমালা থাকার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন শফিকুল আলম।
উল্লেখ্য, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমে কর্মীদের আর্থিকসহ সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে একটি সমন্বিত আইনের প্রস্তাব করেছে সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্র (বিজেসি)। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিজেসি তাদের পর্যালোচনা তুলে ধরে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
বিজেসি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় জানিয়েছে, কমিশনের প্রতিবেদনে সম্প্রচার মাধ্যমকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে কমিশন সাংবাদিকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা অস্পষ্ট। সম্প্রচার সাংবাদিকদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে সাংবাদিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার দাবি জানিয়েছে বিজেসি।
কমিশন তাদের সুপারিশে সাংবাদিকদের জন্য অভিন্ন ন্যুনতম বেতন কাঠামোর সুপারিশ করেছে, যা হবে প্রথম শ্রেনীর সরকারি কর্মকর্তার বেতনের সমান। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া, উৎসব ভাতা, ফোন ও ইন্টারনেট বিল, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ঝুঁকিভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর ভাতা বা গ্রাচুইটি প্রাপ্তির কথাও বলা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের সংবাদপত্র ও চাকুরির শর্তাবলী আইন ও শ্রম আইন বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যম দুই ধরনের গণমাধ্যম এবং তাদের জন্য অভিন্ন বেতন কাঠামো সংগতিপূর্ণ নয় বলেই বিজেসি মনে করে। তাছাড়া ১৯৭৪ সালের আইন শুধুই সংবাদপত্রের জন্য। তাই আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে তা সংশোধন করতে হবে। শ্রম আইনেও সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা বিধান যুক্ত করতে হবে বলে বিজেসি মনে করে।
সম্প্রচার মাধ্যম গণমাধ্যমের জন্য জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন দিয়েছে সেখানে সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য আলাদা বিভাগ রাখার প্রস্তাব করেছে বিজেসি। সম্প্রচার মাধ্যেমর লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আগেই কর্মীদের বেতন কাঠামো, নীতিমালা ও আর্থিক সচ্ছতার বিষয়ে অঙ্গীকারনামা জমা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বিজেসি। সাংকবাদিকদের জন্য একটি ‘কোড অব এথিক্স’ প্রণয়নের দাবি জানিয়ে বিজেসি বলেছে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে প্রস্তুত সংস্থাটি। এক হাউস এক মিডিয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে তা বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করে বিজেসি। তবে সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বিজেসি বলেছে, সাংবাদিকদের নুন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা উচিত। বিজেসি মনে করে সাংবাদিক নিবন্ধনের যে প্রস্তাব কমিশন করেছে তা সাংবাদিক নিপীড়নের নতুন উপায় হয়ে উঠতে পারে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক খায়রুল আনোয়ার মুকুল। আলোচনায় অংশ নেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, ফাহিম আহমেদ, ট্রাস্টি, বিজেসি। যমুনা টেলিভিশনের সিইও নাজমুল আশরাফ, এডিটর ইন চীফ, চ্যানেল ওয়ান, শাহনেওয়াজ পাটোয়ারী, হেড অফ প্রোগ্রাম, আর্টিকেল ১৯, জাফরুল, আইনজীবী। এ আয়োজনে বক্তব্য দেন মোঃ আল মামুন, কান্ট্রি ডিরেক্টর, বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশন। কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন বিজেসির নির্বাহী মিলটন আনোয়ার। বিজেসির সদস্য সচিব ইলিয়াস হোসেনের সঞ্চালনায় সেমিনারের সভাপতি ছিলেন বিজেসির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রেজানুল হক রাজা।
স্বাগত বক্তব্যে বিজেসির সদস্য সচিব ইলিয়াস হোসেন বলেন গণমাধ্যমকে গনমানুষের মাধ্যম করতে হলে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। যুগোযযোগী করে গড়ে তুলতে হবে গণমাধ্যমকর্মীদেরকেও।
বিজেসির ট্রাস্টি ও যমুনা টেলিভিশনের সিইও ফাহিম আহমেদ প্রেস সচিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সংষ্কার কমিশনের যে প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলোকে যেন তিনি গুরুত্ব দেন। প্রয়োজনে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করারও আহ্বান জানান তিনি। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের স্বার্থের বিষয়গুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ারও আহ্বান জানান ফাজিম আহমেদ।
চ্যানেল ওয়ানের এডিটর ইন চীফ বলেন, মালিকরা অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের সিদ্ধান্ত উচিত। সেই মালিক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ি বা দুবৃত্তকারী যেই হোন না কেন। তিনি বলেন মালিকদের বিরুদ্ধে কথা বললে সাংবাদিকদের চাকুরি চলে যায়। সহকর্মীরাও চাকুরি বাঁচাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকেন। সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়াও নাজমুল আশরাফ বলেন, সরকার বা রাজনৈতিক দল সবসময় সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের পক্ষে থাকবে এটা ভাবার কোন কারণ নাই।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। সাংবাদিকতায় থাকতে হবে কোড অব কন্ডাক্ট। ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেও যাবে না। গণমাধ্যমও যেন অন্যদের দ্বারা চালিত না হয় এমন প্রত্যাশা তার। তিনি আরও বলেন, ইতিবাচকভাবে সাংবাদিকরা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে। সাংবাদিকরা একসময় এক জায়গায় দাঁড়ালে যে সবাই কথা শুনতে বাধ্য হত; সেই জায়গাটা আর নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও তিনি বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যখন সাংবাদিকদের কথায় ভুল তথ্য থাকবে না, সাংবাদিকদের কেনা যাবে না তখন তাদের কথা সবাই শুনবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিজেসির চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে স্বাধীন সাংবাদিকতা করা সম্ভব না। তিনি আরও বলেন, গত শাসনামলে কিছু সাংবাদিক সরকারের কাছাকাছি যাওয়ার প্রতিযোগিতায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এই সরকারের আমলে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, যেসব পত্রিকার নাম কেউই জানে না তাদের অনেকের সার্কুলেশন আসে ২ আড়াই লাখ। সেটা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। জনমনে সাংবাদিকদের ওপর এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
রেজোয়ানুল হক আরও বলেন, এই অনাস্থার মুল কারণ দলবাজী, ধান্দাবাজি, স্বার্থবাদীতা। এগুলো সাংবাদিকদের একাংশের ভেতরে ছিল, মালিকদের একাংশের ভেতরেও আছে। তিনি আরও বলেন, রুঢ় বাস্তবস্তা হল মিডিয়া এখন চালাচ্ছে সেলস এন্ড মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট। বিজ্ঞাপনের কারণে নিউজও কমে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের ইউনিয়ন ভেঙে দুই তিন টুকরো হয়েছে। মালিকদের মধ্যে ঐক্য নেই। এই স্বার্থের দ্বন্দ সাংবাদিকদের এক জায়গায় আসতে দিচ্ছে না। শক্ত কোন পদক্ষেপ নিলে হয়ত এটা সম্ভব হতে পারে। তিনি আরও বলেন, কমিশন প্রিন্ট মিডয়া নিয়ে যত কথা বলেছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া নিয়ে তত বলেনি। এই সরকারের আমলেই যেন গণমাধ্যম সংষ্কার কমিশনের কাজ শুরু হয় সেই প্রত্যাশার কথাও জানান তিনি।
মন্তব্য করুন