কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৬:৪৩ পিএম
আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

মানব পাচার সিন্ডিকেটে বিশ্বে ১৫০ বিলিয়ন ডলার মুনাফা

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক মানব পাচার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা। ছবি : সংগৃহীত
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক মানব পাচার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের মুনাফা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। মানব পাচার বর্তমানে ভয়াবহ ও দ্রুত বিস্তার লাভকারী সংঘবদ্ধ অপরাধে রূপ নিয়েছে। এই অপরাধচক্র শিশু, নারী ও পুরুষকে ব্যবহার করছে শ্রম শোষণ, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে, মাদক পাচার ও অনলাইন প্রতারণার মতো নানা অপরাধে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ আধুনিক দাসত্বে জীবনযাপন করছে, যার মধ্যে ১২ মিলিয়ন শিশু এবং ৬১ শতাংশ নারী ও কিশোরী।

বুধবার (৩০ জুলাই) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আন্তর্জাতিক মানব পাচার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ অভিবাসন নেটওয়ার্কের (BDUNNM) কাউন্টার-ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল— ‘সংঘব্ধ অপরাধ মানব পাচার, বন্ধ হোক শোষণের অনাচার।’

সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, গত বছরের শেষ নাগাদ দেশব্যাপী মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৯১টি। এসব মামলা আওতায় প্রায় ১৬ হাজার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়ের করা মামলার মধ্যে মাত্র ৬৬২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি মামলায় দোষীদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজনকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ৫৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। এছাড়া প্রায় ১ হাজার ২০০ জন অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন। নতুনভাবে ১ হাজার ৭৯টি মামলার অভিযোগ আদালতে গঠন করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ২০১৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘টায়ার ২ ওয়াচলিস্ট’এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ একই অবস্থানে অবস্থানে রয়েছে। এটি মানব পাচার প্রতিরোধে দেশের ধারাবাহিক ও দৃশ্যমান প্রচেষ্টার স্বীকৃতি। যদিও এখনও কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মানদণ্ড পূরণে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) খোন্দকার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মানব পাচার একটি ভয়াবহ অপরাধ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বাংলাদেশ পাচার নির্মূলে কঠোর আইন প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করছে। আমাদের প্রচেষ্টার কেন্দ্রে থাকতে হবে ভিকটিমদের অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ।’

জাতিসংঘের রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটরের প্রতিনিধি ও আইওএম’র বাংলাদেশের চিফ অব মিশন ল্যান্স বনেও বলেন, মানব পাচার এখন একটি সংগঠিত, পরিকল্পিত ও মুনাফাভিত্তিক অপরাধ। এটি প্রযুক্তিনির্ভর, আন্তঃদেশীয় এবং বহুমাত্রিক। আমাদের প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক অনুসন্ধান এবং আইনি কাঠামো কাজে লাগিয়ে এই চক্র ভাঙতে হবে। মানব পাচার শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন।

কোইকার ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর সুজিন কং বলেন, আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ লাখ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেছি। পাশাপাশি, ভিকটিমদের জীবন দক্ষতা উন্নয়ন, পুনর্বাসন, এবং সামাজিক পুনঃঅন্তর্ভুক্তিতে কাজ করছি। আমরা চাই, একটি সমাজ গড়ে উঠুক যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে।

বক্তারা আরও বলেন, আইন থাকলেও মানব পাচার প্রতিরোধে বড় বাধা হচ্ছে এর কার্যকর প্রয়োগ, আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার অভাব, অপরাধীদের অর্থের উৎস বন্ধে দুর্বলতা এবং প্রযুক্তির অপর্যাপ্ত ব্যবহার। পাচারকারীরা এখন অনলাইন মাধ্যমে সক্রিয় এবং বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন, অভিবাসন প্রক্রিয়া এবং অর্থনৈতিক ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আলোচনায় আরও উঠে আসে যে, বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় ভিকটিম সুরক্ষা, সাক্ষ্য সংগ্রহ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেক সময় ভিকটিমরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পায় বা সক্ষমতা না থাকায় মামলা প্রমাণ হয় না। আবার অনেকে পাচারের পর বিদেশে আটক থাকায় কূটনৈতিকভাবে সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে জাতীয় রেফারেল মেকানিজম (NRM) সম্প্রসারণ, ভিকটিম শনাক্তকরণ নির্দেশিকা হালনাগাদ, কমিউনিটিভিত্তিক সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রসারণ। এছাড়া, অনিয়মিত অভিবাসনের মূল কারণ চিহ্নিত করে নিরাপদ ও কম ব্যয়ে বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।

অনুষ্ঠান শেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সীমান্ত রক্ষা বাহিনী, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও টাস্কফোর্সকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়। বিশেষ করে গণপরিবহন কেন্দ্র, সীমান্ত এলাকা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নজরদারি ও প্রতিবেদন গ্রহণ ব্যবস্থা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও পুলিশ সদর দপ্তরের সিনিয়র প্রতিনিধি, যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা এবং পাচারকে সংগঠিত অপরাধ হিসেবে মোকাবেলার উপর গুরুত্বারোপ করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাড়ে চার বছর ধরে অচল দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র

গণপরিবহনে তৃতীয় লিঙ্গের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ যাত্রীরা

শ্বশুরবাড়ি থেকে আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

আজকের মধ্যে আলোচনা শেষ করতে চায় কমিশন

সুন্দরবনে কোস্টগার্ডের অভিযানে বন্দুক-গুলি জব্দ

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ

‘চোরাই মোটরসাইকেল গ্যারেজে রেখে বিক্রি করত তারা’

মিয়ানমারে প্রত্যাহার হচ্ছে জরুরি অবস্থা, ডিসেম্বরে নির্বাচন

শিবির নেতা সাদিক কায়েমকে নিয়ে নাহিদের পোস্ট 

স্কুলে মোবাইল-মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করলেন ইউএনও

১০

শেষ টেস্টের আগে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে গিল

১১

কৃষিজমিতে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, অক্ষত পাইলট

১২

মোহাম্মদপুরে সুমন হত্যা মামলার প্রধান আসামি ‘পিচ্চি মুন্না’ গ্রেপ্তার

১৩

সীমান্ত দিয়ে ১০ নারী-পুরুষকে বিএসএফের পুশইন

১৪

বাণিজ্যচুক্তি / হয়তো একদিন ভারতে তেল রপ্তানি করবে পাকিস্তান : ট্রাম্প

১৫

প্লট দুর্নীতি  / শেখ রেহানাসহ তিন সন্তানেরও বিচার শুরু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা 

১৬

তাসকিনের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ প্রত্যাহার করলেন বন্ধু

১৭

যমুনা ইলেকট্রনিক্সের ‘ঈদ ডাবল খুশি অফার’ বিজয়ীদের মধ্যে কুপন হস্তান্তর

১৮

চিরঞ্জীবীর আতিথেয়তায় মুগ্ধ মৌনি

১৯

কাঁঠালের চিপসে বাজিমাত রুপা খাতুনের

২০
X