কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৪:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

৯ দফার আঁতুড়ঘর রুম নম্বর ১২০৪ থেকে বলছি...

তৎকালীর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে উল্লাস। ছবি : সংগৃহীত
তৎকালীর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে উল্লাস। ছবি : সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা ঘোষণা। ২০২৪ সালের (১৯ জুলাই) তৎকালীন সরকারের তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ৮ দফার ঘোষণা দেন তিন সমন্বয়ক। এ সময় তাদের আট দফা প্রত্যাখ্যান করে ৯ দফা ঘোষণা করেন সমন্বয়ক আব্দুল কাদের। এতে পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়।

কিভাবে ৯ দফা ঘোষণা করা হয়েছিল তার বিস্তারিত তুলে ধরে স্মৃতিচারণ করেছেন সাংবাদিক অন্তু মুজাহিদ। বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) মধ্যরাতে নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। ‘৯ দফার আঁতুড়ঘর রুম নম্বর ১২০৪ থেকে অন্তু মুজাহিদ বলছি...’ শিরোনামে স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

সে সময়ে ঘোষিত ৯ দফা হলো : দাবিগুলো ছিল- ১. ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনাকে) জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ২. ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও দল থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ৩. যেসব এলাকায় ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার পুলিশের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারকে বরখাস্ত করতে হবে। ৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে। ৫. নিহত ও আহত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৬. ছাত্র হত্যার দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের আটক ও হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। ৭. দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ও ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে। ৮. অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে এবং ৯. আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থী যেন একাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনো হয়রানির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

স্মৃতিচারণে অন্তু মুজাহিদ লিখেন, কালবেলার সাবেক সহকর্মী ইসরাফিল ফরাজী আমাকে সঙ্গে নিয়ে কাঁটাবনের একটি বহুতল ভবনে নিয়ে গেলেন। একটি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের রুম নম্বর ১২০৪-এ প্রবেশ করতেই সেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে দেখলাম, যারা এক রুম থেকে আরেক রুমে ছোটাছুটি করছেন, কেউ ফোনে কথা বলছেন। পাশের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম ৪-৫ জন মিলে ল্যাপটপে কিছু একটা লিখছেন (পরে জানতে পারি ৯ দফা দাবির ড্রাফট প্রস্তুত করা হচ্ছে। সেখানে আবু সাদিক কায়েম, সিবগাতুল্লাহ সিবগা, মুতাসিম বিল্লাহ সাহেদি, এসএম ফরহাদ, মোসাদ্দেক আলি ইবনে মোহাম্মদসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। তবে তাদের পরিচয় পরে জেনেছি।)। তাদের কেউ ফোনে ডিরেকশন দিচ্ছেন, আন্দোলনের মাঠে কোথায় পানি পৌঁছাতে হবে, কারা যেন গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দিচ্ছেন। সবাইকে খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। আবার কেউ যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরার আপডেট নিচ্ছেন।

তিনি উল্লেখ করেন, মনে হচ্ছিল যেন এটাই আন্দোলনের কন্ট্রোলরুম। এ সময় আমার ব্যাগে থাকা দুটি পেয়ারা ওই অফিসের এক জুনিয়রকে দিয়ে কেটে সবাইকে দিতে বললাম। এরই মধ্যে ৯ দফার ড্রাফট প্রস্তুত হলো। ইসরাফিল ফরাজী ভাই ভাষাগত ভুলগুলো ঠিক করে আমাকে ওই ড্রাফটে বানান ভুল আছে কিনা সেটা দেখে কারেকশন করে দিতে বললেন। ওই ৯ দফা কার নামে যাবে সে বিষয়ে আলোচনা চলছে। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো যে আব্দুল কাদের যেহেতু সেফ জোনে আছে, তার নামে দেওয়া হবে। এরপর আব্দুল কাদেরকে সেগুলো পড়ে শোনানো হলো। দু-একটি বিষয়ে সে সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করছিলেন (ফোনের এপাশের কথাবার্তায় যতটা বুঝেছি)। সেগুলো কারেকশন করে এক পর্যায়ে ড্রাফট চূড়ান্ত করা হলো। এরপর কাদেরকে ফোন করে জানানো হলো যে, এই ৯ দফা তার নামে পাঠানো হবে এবং সংবাদকর্মীদের কাছে তার ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হবে। তাকে বলে দেওয়া হলো মিডিয়া যদি ৯ দফার বিষয়ে জানতে চায় সে যেন বলে হ্যাঁ, ৯ দফা আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ৯ দফা প্রস্তুত। কিন্তু মিডিয়াতে কীভাবে পৌঁছানো যায়, সেটা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে গেলাম আমরা। রুমে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সফট কপি প্রিন্ট করতে হবে। বাইরে গোলাগুলি চলছে। কাঁটাবন বাটা সিগন্যাল এলাকা থমথমে। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা এটা বাটন ফোন থেকে ম্যাসেজ দিব, আর বাংলামোটর থেকে প্রিন্ট করিয়ে বিভিন্ন হাউজে পৌঁছে দিব। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। আমরা ওই ভবনের নিচে এলাম। মেইন গেট বন্ধ। কলাপসিবল গেটে ডাবল তালা দেওয়া। বাইরে পুলিশ অ্যাকশন মুডে। আমি দারোয়ানকে রিকোয়েস্ট করায় তিনি গেট খুলবেনই না। পরে ঝাড়ি দিতেই বললো মামা সাবধানে যাইয়েন, পুলিশ কিন্তু গুলি করতাছে। আমি আগে বের হলাম। কালবেলার আইডি কার্ড হাতে নিয়ে। পিছনে ইসরাফিল ফরাজী, সিবগাতুল্লাহ, মোসাদ্দেকসহ কয়েকজন। আমি সবাইকে বললাম, আপনারা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা আমাকে অনুসরণ করবেন। পুলিশকে যা বলার আমি বলবো।

তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি লিখেন, সামনে পুলিশ ফুল অ্যাকশন মুডে আছে। প্রথম দুই সারির পুলিশ সড়কে শুয়ে রাইফেল তাক করে আছে। পিছনে এখন লাইন (সম্ভবত) হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেল তাক করে আছে আর বাকিরা পিছনে দাঁড়িয়ে। আমরা তাদের বাম পাশ দিয়ে অতিক্রম করছি। কাছাকাছি যেতেই একজন অফিসার ছুটে আসছেন, আমি কালবেলার আইডি কার্ড দূর থেকে দেখিয়ে বলছি, সাংবাদিক, আমরা সাংবাদিক। তখন তারা আমাদের ইশারা দিয়ে বললেন, দ্রুত এখান থেকে চলে যান। আমরা ডান পাশের গলি দিয়ে বাজারে পৌঁছে গেলাম। এরপর মোসাদ্দেক ও এবি জুবায়েরসহ ৩ জনকে রিকশা ঠিক করে দিলাম।

অন্তু মুজাহিদ লিখেন, আমরা গিয়ে আবার মিলিত হলাম বাংলামোটর ইসরাফিল ফরাজী ভাইয়ের আরেকটি অফিসে। সেখান থেকে প্রিন্ট করা ৯ দফা নিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে ৪ জনকে বণ্টন করে দেওয়া হলো। একটি বাইক সময় টিভি, বিজয় টিভি, বাংলাভিশন, ইটিভি, আরটিভি, এনটিভি, এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ, মানবজমিন, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার যাবে। অপর বাইকটি চ্যানেল২৪, দীপ্ত, চ্যানেল আই হয়ে ডিবিসি, বৈশাখী টেলিভিশন, যমুনা টিভি, যুগান্তর হয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়াতে পৌঁছাবে। অবশ্য ওই ভবনে থাকতেই আমরা কোন কোন মিডিয়ার রিপোর্টারের নম্বর আমার কাছে আছে তার তালিকা করেছিলাম এবং তাদের নম্বরে ম্যাসেজ করে ৯ দফা পৌঁছেছিলাম। এমনকি ওভার শিউর হওয়ার জন্য কাউকে কাউকে ফোনও দিয়েছি। বাংলা ভিশনের সাংবাদিক সাবেক সহকর্মী কেফায়েত শাকিল ভাইকেও ফোন করে জানিয়েছিলাম ৯ দফা লাগবে কি না, কিংবা পেয়েছেন কি না?

তিনি উল্লেখ করেন, বৃষ্টি পড়ছে। ৯ দফা আর ইসরাফিল ভাইকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলাম এখন টিভির কার্যালয় টিকাটুলির দিকে। পথে পথে বিভীষিকা। চারপাশে সংঘর্ষ বাধে বাধে অবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাহারায় কড়া সেনা নিরাপত্তা মতিঝিলের আশপাশের এলাকায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও কাজ হচ্ছে না। পরে দায়িত্বরত কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলে রিকোয়েস্ট করে মতিঝিল থেকে সামনে এগোলাম। সম্ভবত উটের খামারের পাশ দিয়ে। এবার বের হতে আবার চেকপোস্ট। সেনাবাহিনী আটকে দিলেন। পরে তাকেও আরেক দফা বুঝিয়ে এখন টিভির সামনে পৌঁছালাম। পার্কিংয়ে বাইক রেখে বেশ কিছু সময় মাহমুদ রাকিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো। ৯ দফা যাতে এখন টিভির পাশাপাশি তার পরিচিত সাংবাদিকদের কাছেও তিনি পৌঁছে দেন সে রিকোয়েস্টও করা হয়। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে পৌঁছালাম আমার কর্মস্থল কালবেলায়। সফট কপি আরও আগেই কালবেলার অনলাইন এডিটর পলাশ মাহমুদ ভাই, অনলাইন শিফট ইনচার্জ আবু আজাদ ভাই ও হার্ড কপি কালবেলার সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ভাইয়ের কাছেও পৌঁছানো হলো।

তিনি জানান, এভাবেই ৯ দফা চোখের সামনে লেখা হলো, নিজ হাতে বানান কারেকশন করলাম, নিজের ডিসকভার ১০০ সিসি বাইকটাতে করে মিডিয়াতে পৌঁছে দিলাম। এরপরও অনেকে ভুল তথ্য উপস্থাপন, মিথ্যাচার করেছেন। আমরা চুপ করে আছি মানেই এই না যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে যে কেউ তামাশা করে যাবে আর ছাত্র-জনতা চুপ করে বসে থাকবে। সেদিন পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশ ও দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপোষহীন থেকে আন্দোলনের পক্ষে কাজ করে গেছি।

পোস্টে অন্তু মুজাহিদ আরও উল্লেখ করেন, আবার যদি দেশের ও দেশের মানুষের যৌক্তিক আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয় সেটার জন্যও দ্বিধা করব না। জুলাইয়ে দেশের প্রত্যেকটি সংক্ষুব্ধ মানুষের, দেশপ্রেমিক জনতার, ক্ষেতের মজুর, রেমিট্যান্স যোদ্ধা, পোশাক শ্রমিক, কল-কারখানা শ্রমিক, চা বাগানের শ্রমিক, কৃষকের, ছাত্র-জনতার, পুলিশ, সরকারি চাকরিজীবীদের সবার। তাই, গণমানুষের লাল জুলাইকে কাটাছেঁড়া করা থেকে বিরত থাকুন, সব স্টেককে প্রাপ্ত সন্মান দিন, জুলাই বেচাবিক্রি বন্ধ করুন, জুলাই হোক সম্মানের, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সিলেটে পাথর লুটপাটকারীদের নিয়ে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে দুদক

প্লট ও ফ্ল্যাট বরাদ্দে মন্ত্রী-সচিবসহ যাদের কোটা বাতিল

১১ বছর আগে মারা যাওয়া স্বামীই সন্তানের বাবা, দাবি অন্তঃসত্ত্বার

ডাকসু নির্বাচন / দ্বিতীয় দিনে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন ১৩ জন

জরায়ুর বদলে লিভারে বেড়ে উঠছে ভ্রূণ, বিস্মিত চিকিৎসকরাও

ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না : অর্থ উপদেষ্টা

মোদির হাতেই দেশ নিরাপদ, বললেন কংগ্রেস নেতা

অসহায় বিধবা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিলেন তারেক রহমান

এবার জাফলংয়ে পাথর লুটপাট বন্ধে অভিযান

ইবতেদায়ি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তি নিয়ে সুখবর

১০

একবার ফোন চার্জ দিলে কত টাকা খরচ হয় আপনার? জেনে নিন

১১

১২ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স এলো ১২ দিনে

১২

ভারতকে পাক সেনাপ্রধানের পরমাণু যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

১৩

এসএসসি পাসেই পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি, নেবে ২৮৪ জন

১৪

বিচ্ছেদের পর কাজ থেকে বিরতি, এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ফারিয়া

১৫

হস্তান্তরের আগেই নবনির্মিত স্কুল ভবনে ফাটল

১৬

পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়ায় শিক্ষিকাকে মারধর করল ছাত্র

১৭

অভাব-ঋণের ভারে মা-মেয়ের বিষপান

১৮

বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটি ধর্মভিত্তিক দল : রিজভী

১৯

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় যে ৬ খাবার, বাদ দিন এখনই

২০
X