

নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিন শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি।
এদিন চলন্ত রিকশায় থাকা হাদিকে মোটরসাইকেলে এসে দুর্বৃত্তরা গুলি করে পালিয়ে যায়। তিনি এখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে সন্দেহভাজন একজনকে শনাক্ত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ছাড়া মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) আরও তিন-চারজনকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে। সন্দেহভাজনদের গোয়েন্দা জালের মধ্যে ফেলে দ্রুত গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আশাবাদী পুলিশ ও র্যাব।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে সিসিটিভির ফুটেজের একই ব্যক্তির দুটি ছবি পাঠিয়ে তার ব্যাপারে তথ্য দিতে সবাইকে অনুরোধ জানায় ডিএমপি।
পরে পুলিশ ও র্যাবের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল ওরফে দাউদ খান। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। এরই মধ্যে তার দেশত্যাগ ঠেকাতে সব বিমানবন্দর, স্থল ও নৌবন্দরে বার্তা পাঠানো হয়েছে। ব্লক করে দেওয়া হয়েছে তার পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। ফয়সালসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা মূল সন্দেহভাজনকে খুঁজছি। আশা করি, ধরতে পারব। আমরা জনগণের সহযোগিতা চাচ্ছি। এখনো ২৪ ঘণ্টা পার হয়নি। শিগগির হত্যাচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
এ ঘটনায় কতজন জড়িত– জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, একজনের ছবি প্রকাশ করলেও সন্দেহের তালিকায় এখন পর্যন্ত তিন-চারজন রয়েছে। তাদের বিষয়ে আমরা তথ্য নিচ্ছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চলছে।
এদিকে ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা ফেসবুকে হাদিসহ কয়েকজনের একটি ছবি প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনজনকে চিহ্নিত করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই তিনজনকে যে কোনো মূল্যে ধরিয়ে দিন। বাংলাদেশের জনতা আপনারাই ইনকিলাব কর্মী, আপনারাই এই ভার হাতে নিন। প্রশাসন কোথায় আমাদের আপডেট দেবে, তা না করে উল্টো আমাদের কাছেই আপডেট চাইতেছে।’
ইমিগ্রেশন পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার গুলির ঘটনার পর যখন সন্দেহভাজন হিসেবে ফয়সালের নাম-ছবি সামনে চলে আসে, তখন থেকেই সীমান্তের সব পয়েন্টে সতর্ক করে দেওয়া হয়। আর শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশনা পাওয়ার পর তার পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে সব বন্দরকে সতর্ক করা হয়েছে। ফলে বৈধভাবে তার দেশত্যাগের আর কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সদস্য হয়েছিলেন ফয়সাল করিম দাউদ খান। সূত্র জানিয়েছে, গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সালই সেই ব্যক্তি। পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। এই অ্যাকাউন্টটি যে ফয়সালেরই, তা ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা নিশ্চিত করেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে।
লিংকডইনে ফয়সাল নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও অ্যানালিস্ট ওয়ার্ক নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন তিনি।
এদিকে, ফয়সাল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে জানা যায়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তার নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয়কারী দলেও ছিলেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফয়সালও সক্রিয় ছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার সঙ্গে তার ছবি সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেছে।
সন্দেহভাজন ফয়সাল করিমের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে। তার বাবার নাম হুমায়ুন কবির। এলাকাবাসী জানান, হুমায়ুন কবির হাওলাদারের ছয় ছেলে। তিন ছেলে বাড়িতেই থাকেন। বড় ছেলের নাম রাজ্জাক হাওলাদার, তিনি মারা গেছেন। মেজো ছেলে সেলিম ও আবদুর রব একই বাড়িতে থাকেন।
স্থানীয় গ্রাম পুলিশ সদস্য আসলাম চৌকিদার বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগে হুমায়ুন কবিরের মেজো ছেলে সেলিম তুচ্ছ ঘটনায় তার মাকে ছুরিকাকাঘাত করেন। পরে তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। এরপর আর কখনো বাড়িতে আসেননি।
বাউফল থানা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ফয়সাল ঢাকার আদাবর থানার পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটিতে থাকেন। তার বিরুদ্ধে আদাবর থানায় মামলা রয়েছে।
সূত্র : সমকাল
মন্তব্য করুন