পদ্মা সেতু একটি স্বপ্নের নাম। বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস। পদ্মা সেতু যেমন দেশের গর্ব, তেমনি সমৃদ্ধ করছে দেশের অর্থনীতিকে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থারই উন্নয়ন ঘটায়নি, বেড়েছে এসব অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। পদ্মা সেতুতে এক বছরে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। আর এ আয় থেকে ৬৩২ কোটি ৯৩ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেতু-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনে আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। আর সেতুর প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে যে গতি এসেছে, তা আরও সম্প্রসারিত হবে।
বিশ্বব্যাংকের ধারণায় পদ্মা সেতুতে প্রতিদিন গড়ে ৭ হাজার যান চলাচল ধারণ করা হলেও বাস্তবে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ হাজার গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করছে। অর্থাৎ গত এক বছরে এই সেতু পাড়ি দিয়েছে ৫৬ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি যানবাহন, যা থেকে এক বছরে আয় হয়েছে ৭৯৪ কোটি টাকারও বেশি।
এরই মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা পরিশোধ করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। গত ১৯ জুন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের কাছে এ টাকা তুলে দেন সেতু সচিব মো. মনজুর হোসেন।
এর আগে গত ৫ এপ্রিল প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির মোট ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার ৫০ টাকা পরিশোধ করা হয়। এর ফলে প্রথম বছরে সর্বমোট ৬৩২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় পুরো অর্থ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সেতু সচিব মনজুর হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এক বছরে চারটি করে কিস্তি; মোট ৩৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। প্রথম বছরে যে ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল, সেটা আমরা ২৫ জুন আসার আগেই পরিশোধ করে দিয়েছি। যে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল, তার চেয়ে বাস্তবে অনেক বেশি উপকার দিচ্ছে পদ্মা সেতু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রতিরোধ্য এ অগ্রযাত্রা কেবল শুরু। প্রতিদিনই এই পথে যানবাহনের সংখ্যা বড়ছে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পায়ন ও নানা রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। ফলে শুধু সেতুর আয় নয়, এরই মধ্যে বেড়েছে ওইসব অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থাও। সাবেক সেতু সচিব বেলায়েত হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমাদের জিডিপিতে ওয়ান পয়েন্ট টু পারসেন্ট অ্যাড করবে, সেটা আমি মনে করি। প্রত্যাশা এবং প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সেটা সম্মিলন ঘটেছে পদ্মা সেতু। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল, আমি মনে করি, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি এটার মধ্যে একটা সুন্দর সম্মিলন ঘটেছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এখনো সেতু এলাকায় প্রমত্তা পদ্মা বশে আনতে নদীশাসনের বেশকিছু কাজ বাকি। তবে এরই মধ্যে আরও এক দফায় ১ হাজার ৫২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা বাড়ানো হয়েছে এই সেতুর নির্মাণ ব্যয়, যা মূলত ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণেই হয়েছে।
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা ২০২৩ সালে কাজ শেষ করব। যে কাজটা বাদ থাকবে, সেটা হয়তো পয়েন্ট টু বা থ্রি পারসেন্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। দুই স্তরবিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত এই সেতুর ওপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০ দশমিক ১২ মিটার বা ৪৯২ দশমিক ৫ ফুট এবং চওড়ায় ২২ দশমিক ৫ মিটার বা ৭৪ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার বা ৩ দশমিক ৮২ মাইল। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। ১২০ মিটার বা ৩৯০ ফুট গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু এটি।
মন্তব্য করুন