ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৩, ০১:০৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের সাক্ষাৎকার

যারা অবৈধ কাজ করছে তাদেরকেই সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। ছবি : কালবেলা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। ছবি : কালবেলা

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বাংলাদেশের একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সপ্তম গভর্নর। তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রথম উপাচার্য ছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে মুদ্রানীতি, ব্যাংক তদারকি তথা ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্কার কাজে হাত দেন তিনি। তিনি ঋণখেলাপি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তার গৃহীত নীতিমালার ফলে রেমিটেন্স প্রবাহে অগ্রগতি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি ন্যূনতম পর্যায়ে ছিল। দারিদ্র্য নির্মূল ও অসুবিধাগ্রস্ত ডিসঅ্যাবলড জনগোষ্ঠী বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করছেন তিনি। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রিজার্ভ সংকট, মূল্যস্ফীতিসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

কালবেলা: ২০০৯ সাল পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো পারফরম্যান্স করেছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও সংকটের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দীর্ঘদিন পরেও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না কেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: করোনা-পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি চলমান রয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে সময়ে বাংলাদেশের জিডিপিতে মারাত্মক ধস হয়েছে সেটা আগে জানা যায়নি। দেরিতে হলেও এটা আমরা জানতে পেরেছি। ২০১৯-২০ সালে বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে সেটি ধরে রাখার জন্য যা করা দরকার ছিল, সেগুলো করা হয়নি। যেমন— শ্রমজীবীদের দক্ষতা ও অংশগ্রহণ বাড়াতে পারিনি, যেসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে উৎপাদন বাড়বে সেসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারিনি। সব থেকে বড় বিষয় হলো, যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন করা সম্ভব এবং উচিত সেগুলো আমরা আমদানি করছি। আমদানি করলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে না। সেটিই হয়েছে। আমদানি বেড়েছে বিপুল, যার চাপ সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।

অনেক দেশ পরিকল্পনা করেছিল তারা গাড়ি আমদানি না করে প্রথমে নিজ দেশে গাড়ি অ্যাসেম্বল করবে এবং পরে তারা নিজেরাই গাড়ি তৈরি করবে। তেমনি বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে দেশে গাড়ি অ্যাসেম্বল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা যদি দেশে গাড়ি তৈরি শুরু করতাম তাহলে আজ আমাদের গাড়ি আমদানি করতে হতো না।

বাংলাদেশে অর্থনীতির অগ্রগতি হয়েছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে আয়বৈষম্য বেড়েছে; এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। একটা শ্রেণির হাতে বিপুল অর্থ জমা হয়েছে। তারা সেই অর্থে গাড়ি আমদানি করেছে, বিলাসবহুল ফার্নিচার আমদানি করেছে। তারা গৃহনির্মাণের সামগ্রী বিদেশ থেকে আনিয়েছে। অথচ এই সবকিছুই নিজ দেশে উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। নীতিনির্ধারকদের অজান্তেই এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে যে উৎপাদন কাঠামো তৈরি হয়েছে সেটা প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হয়নি। বিভিন্ন সমীক্ষায় আমরা দেখেছি বাংলাদেশে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। দেশে লেখাপড়ার মান কমেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের দেশে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পড়াশোনা হচ্ছে না, যা খুবই উদ্বেগের। ফলে যতটা উৎপাদন হওয়া উচিত ছিল তার থেকে অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ার কারণে আমদানি হচ্ছে বেশি। ফলে প্রবৃদ্ধিও কম হচ্ছে। জনসম্পদের মান উন্নত না হওয়ায় বিদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করতে হচ্ছে। আর এটি হিসাবের মধ্যে যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে হিসাবের বাইরে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ফলে হুন্ডির মাধ্যমে অনেক অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে কৃষির প্রবৃদ্ধি জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে খুব অল্পই ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া আগের বছরগুলোতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এত বেশি এবং জিডিপি এত বড় হয়েছে যে প্রাথমিক খাতের অবদান এখন মাত্র ১২ শতাংশ। ফলে প্রাথমিক খাতের প্রবৃদ্ধি চলমান থাকলেও সেটা মোট প্রবৃদ্ধিতে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না।

কালবেলা: বাংলাদেশের অর্থনীতির এখনকার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি ভারত-শ্রীলঙ্কাসহ অনেকেই একে নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ কেন পারছে না?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: এটা খুবই দুঃখজনক। পৃথিবীর সকল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নম্বর লক্ষ্য থাকে দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। মূল্য স্থিতিশীল রাখলে স্থানীয় মুদ্রার মান স্থিতিশীল থাকে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও সুদের হার নিয়ন্ত্রণে থাকে। সুদ হারের তারতম্যের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে কমানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ভারত এমনকি সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ শ্রীলংকা। তারা সবাই এই নীতি অনুসরণ করেছে। শ্রীলঙ্কা এক বছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬৯ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা বারবার বলেছেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তাদের এই কথা একেবারেই হাস্যকর। সরকারের পরামর্শক যারা রয়েছেন তাদের এখনই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। শুধু সুদের হার বৃদ্ধি করাই নয়, একই সঙ্গে ব্যাংকে আমানত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করাও উচিত নয়। যাতে দেশের মানুষের হাতে যে টাকা রয়েছে সেটা অন্য কোনোভাবে নষ্ট না হয়ে ব্যাংকের কাছে আসে।

এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমানতের সুদের হার বাড়ালে ব্যাংক থেকে যে ঋণ দেওয়া হবে তারও সুদের হার বাড়াতে হতে পারে। তখন তো মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। কিন্তু এটা যে ঘটে না তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেসব প্রকল্প সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল শুধু সেখানেই ঋণ যাবে। তারা উৎপাদন করবে এবং ব্যাংককে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবে। কিন্তু আমাদের দেশে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যায়, যারা বেসরকারি ব্যাংকের মালিক তারাই আবার শিল্প উদ্যোক্তা। ব্যাংকে মুনাফা এত বেশি এবং দ্রুত আসে যে সবাই ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে চায়। স্প্রেড যা দেখানো হয় বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ব্যাংকের পর ব্যাংক তৈরি হয়েছে। আমরা দেখেছি অর্থনীতির দুর্দিনেও ব্যাংকগুলো অনেক মুনাফা করছে। মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর কার্টেলকে ভেঙে দিতে হবে।

দেশে পণ্যের বিরাট মজুদ রয়েছে অথচ দাম বেড়ে যাচ্ছে, এটা আশ্চর্যের বিষয়। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। এটা কেমন কথা! সিন্ডিকেট কতিপয় মানুষের সৃষ্টি, যারা আইন ভঙ্গ করছে এবং তারা একেবারেই ভীত। তাদের বিরুদ্ধে দুভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। প্রথমত, সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু সরকার সেদিকে যায়নি। সেক্ষেত্রে আমরা বলেছি, যেখানে পাঁচজনকে পণ্য আমদানির লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সেখানে ৫০ জনকে দেওয়া হোক। তাহলে প্রতিযোগিতা হবে। আর প্রতিযোগিতা হলে তারা সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ পাবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারি উদ্যোগগুলোকে বিল্ডআপ করতে হবে। টিসিবির মতো প্রতিষ্ঠানকে জোরদার করে সরকারের বড় আকারে নিজস্ব মজুদ গড়ে তুলতে হবে। যেসব ব্যবসায়ীরা বাজার ম্যানিপুলেট করে, যারা সিন্ডিকেট করে তাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে সরকারের কাছেও বিকল্প মজুদ রয়েছে। ৯৮ সালে আমরা দেখেছি সরকার ১৫ লাখ টন ধান-চাল মজুদ করে রেখেছিল। দেড় কোটি মানুষকে ৯ মাস ধরে তা খাওয়ানো হয়েছিল। তখন ধান-চালের দাম বাড়েনি। এ ছাড়া আরও একটি বিষয় আছে। সেটি হলো সমবায়। সরকার যেকোনো কারণে হোক এটাকে ভয় পায়। এই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে যারা সিন্ডিকেট করছে এবং যারা বাজার মেনিপুলেট করছে তারা লাগামছাড়া হয়ে গেছে। আগে বাজার তদরকি করার একটি ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই তদারকি করার ব্যবস্থা এখন আর নেই। এখন বাজার তদারকি হয় ক্যামেরার সামনে। অর্থাৎ ক্যামেরা যখন যায় তখন ক্যামেরার সামনে তদারকির ভাব দেখানো হয়। এরপর ক্যামেরা চলে গেলে আবার যা তাই।

খুচরা বাজারে তদারকির চেয়ে পাইকারি বাজারে তদারকিটা বেশি প্রয়োজন। বিক্রেতাদের একটি বড় অস্ত্র হলো মোবাইল। মোবাইলের মাধ্যমে তারা নিজেরাই ঠিক করে নেয় দাম কত হবে। আড়তদার কোনো তদারকি নেই। অথচ তারাই আসল জায়গা। তারা আমদানি করে অথবা দেশের মধ্য থেকে পণ্য কিনে মজুদ গড়ে তোলে। সেখানে যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা হলে এবং সরকারি একটি বাফার মজুদ গড়ে তোলা হলে দেশে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আরো একটি ভয়ংকর সমস্যা হলো কৃষক বা যিনি উৎপাদন করেন তিনি ন্যায্য মূল্য পান না। নানাভাবে কৃষক শ্রেণিকে শোষণ করা হচ্ছে। প্রথমত তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, তারা যখন কৃষির উপকরণ কিনতে যাচ্ছেন তখন অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই আমার কাছে মনে হয় উৎপাদন ও বিপণন সমবায় ছাড়া কৃষির বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

উৎপাদন ও বিপণন সমবায় করলেই কৃষকদের তিন বা চার শতাংশ সুদে মূলধন দেওয়া সম্ভব হবে। এখন ২১ লাখ টন পণ্য মজুদ করার সক্ষমতাসম্পন্ন গুদাম রয়েছে দেশে। সেটাকে ৩০ বা ৩৫ লাখ টনে উন্নীত করতে হবে। কৃষক যেন নিজে তার উৎপাদিত পণ্য সেখানে রাখতে পারেন এবং নিজের সুবিধামতো সময়ে বাজারে তা ছাড়তে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কৃষকের শোষিত হওয়ার সুযোগ কমে যাবে। কৃষক উৎসাহজনক মূল্য পাবেন। আবার ভোক্তা পর্যায়ে কম দামে পণ্য পাবে। কৃষক এবং ভোক্তার মাঝে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমে যাবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর নানা উপায় রয়েছে কিন্তু সরকার তার একটিও ব্যবহার করেনি। উল্টো আমাদের নীতিনির্ধারকরা বলছেন এখানে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। তারা আগুনে আরো ঘি ঢেলেছেন।

কালবেলা: আমরা জানি বিশেষ করে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবুও আমরা দেখছি আমাদের চাল, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। এটা কেন করতে হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: যারা সিন্ডিকেট করছে তাদের হাতে আমরা খেলছি। দেশে ডিমের চাহিদা দৈনিক সাড়ে তিন থেকে চার কোটি। কত ডিম আমদানি করবেন? এভাবে আমদানি করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ডিমের উৎপাদন দেশেই হয়। আমদানি না করে দেশীয় উৎপাদনে প্রণোদনা দিয়ে দাম স্থিতিশীল করা দরকার। কৃষক আলু উৎপাদনের পর যে দামে বিক্রি করেন অফ সিজনে তার থেকে তিন গুণ/চার গুণ বেশি দামে সেই কৃষকই আবার সেটা কিনে খেতে হয়। কৃষক যে দামে বিক্রি করতে পারেন তার থেকে তিনগুণ চারগুণ দামে ভোক্তাকে কিনে খেতে হয়। এসব ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা করা দরকার। যারা এ সকল ব্যাপারে আগ্রহী যেমন আমি একজনের নাম বলি, প্রফেসর আব্দুস সাত্তার মন্ডল, তিনি এসব ব্যাপারে অনেক চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা করেছেন। তার মতো আরও দু-চারজন ব্যক্তিকে নিয়ে যদি একটি প্রাইস কমিশন করা যায় তাহলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এই ধরনের প্রাইস কমিশন রয়েছে। সরকারের একেকজন একেক রকম কথা বলেন। যিনি যে ব্যাপারে অথরাইজ নন তিনিও সে ব্যাপারে কথা বলেন। আর এ কারণেই বড় ধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়। তাই যে যার মতো কথা না বলে জাতীয়ভাবে একটি প্রাইস কমিশন গঠন করে তাদের পরামর্শ নিয়ে সেই ভিত্তিতে যদি কাজ করা যায় তাহলে এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।

কালবেলা: আমরা দেখেছি কৃষককে ব্যাংকঋণ দিলে কৃষক সেই টাকা ফেরত দেন। কিন্তু শিল্পে এবং বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তা ফেরত আসছে না। অথচ ব্যাংকগুলো তাদেরই বেশি ঋণ দিতে উৎসাহী। এটা কেন ঘটছে?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সাধারণ অর্থে বললে, ব্যাংকে যারা ঋণ দেন যেমন ম্যানেজার বা অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ী মহলের এক ধরনের সৌহার্দ্য থাকে। ব্যাংকের এই উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এবং যারা বড় বড় ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপি হয়ে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করছে তারা একই শ্রেণির মানুষ। এই সমস্যার একটি বড় কারণ হলো নজরদারির অভাব। আমরা পাকিস্তানের একটি উদাহরণ দিই। আমরা প্রতিদিন বলি পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র, তাদের দেশে এই সমস্যা সেই সমস্যা। অথচ এই পাকিস্তানই মানি লন্ডারিং প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে। ফলে গত সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পাকিস্তানি রুপির দাম ৩০৬ টাকা থেকে ২৯০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। তাদের মুদ্রার মান ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তারা যদি পারে আমরা কেন পারব না? সরকারপ্রধানকে ভালোমতো অবহিত করলে এবং তিনি নীতিনির্ধারণ করে দিলে এই সংকটের সমাধান একেবারেই কঠিন নয়। শ্রীলঙ্কা থেকে আমাদের অর্থনীতি অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। অথচ আমরা আমাদের নীতিনির্ধারণী সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করছি এবং তার বৃদ্ধি করছি। আগামী ২০২৫ সাল থেকে বাংলাদেশকে বার্ষিক যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণের সুদ এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে তাতে আমরা আরও বড় ধরনের সমস্যায় পড়ব। এই সংকট মোকাবিলা করতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে, আমদানি কমাতে হবে এবং রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে।

দেশের মধ্যে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় সেসব খাতকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের মতো খাতকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। এসব খাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে অতি অল্প সুদে তাদের ঋণ দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে বিসিককে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যদি ১০০ কোটি বা ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে লাখ উদ্যোক্তা তৈরি করাই আমাদের আল্টিমেট লক্ষ্য হওয়া উচিত।

কালবেলা: আমাদের মূল্যস্ফীতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে দেশের রিজার্ভ সংকট। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের হঠাৎ দ্রুত পতন ঘটছে। এই সংকটের কারণ কী?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: দেশের আমদানি এবং রপ্তানির মোট মূল্যের পার্থক্যের ফলে রিজার্ভ তৈরি হয়। আমদানি এবং রপ্তানি মূল্যের পার্থক্য যত বড় হয় রিজার্ভ তত বৃদ্ধি পায়। আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখছিল রেমিট্যান্স। আমদানি কমানোয় আমাদের রিজার্ভ সংকটে প্রভাব ফেলেছে। যদি ভোগ্যপণ্য আমদানি কমানো হয় তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যায়। আর যদি মূলধনী পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি কমানো হয় তাহলে উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদন কমে গেলে ভোগ ও রপ্তানি কমে যাবে। আমাদের ক্ষেত্রে এটিই ঘটেছে। আমরা যদি গাড়ি আমদানি না করে গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানি করি তাহলে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং সেটা অর্থনীতিতে একটি পজিটিভ ভূমিকা রাখে। এখানে ক্ষতির সম্মুখীন হয় খুব অল্প সংখ্যক মানুষ। আর তারা হলো গাড়ির আমদানিকারক। তারা সব সময় বড় সুবিধা পেয়ে আসছে, তারা প্রচুর মুনাফা করে এসেছে। এখন স্বল্প সংখ্যক মানুষের মুনাফা বন্ধ হয়ে যদি অর্থনীতিতে পজিটিভ একটি দিক যুক্ত হয় যদি ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয় সেটাইতো দেশের জন্য ভালো। আমদানিকারকরা কিছু দিন অপেক্ষা করুন। ভারত, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, ব্রাজিল এসব দেশ এমনভাবেই এগিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের এখনকার রিজার্ভ সংকটের মূল কারণ, দেশের রপ্তানি না বাড়া। রেমিট্যান্স বাড়ছে না বরং হয়তো সেটা কমছে। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দায় দ্রুতগতিতেই বাড়ছে। এই কারণেই রিজার্ভের ক্ষয় আমরা রোধ করতে পারছি না। আমি এক মাস আগেও হয়তো বলতাম আমাদের ২০-২১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে, সুতরাং আমাদের কী চিন্তা। কিন্তু এখন আমি হিসাব করে দেখেছি, আমাদের প্রতি মাসে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে তা রিজার্ভের জন্য আসলেই উদ্বেগের। আমি বারবার বলছি, বিদেশি ঋণে বাংলাদেশের যে বড় বড় প্রকল্পগুলো চলছে তাদের কাছ থেকে পুনঃতফসিল করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য অন্তত ঋণ পরিশোধ স্থগিত করে নেওয়া হোক। আমরা কোনোদিন ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়নি। পুনঃতফসিলের মাধ্যমে যদি আগামী পাঁচ বছর আমরা ঋণ পরিশোধের মাত্রাটা একটু সহনীয় মাত্রায় রাখতে পারি এবং আমাদের রপ্তানিকে বহুমুখী করতে পারি তাহলে আমরা আগামীর সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব।

কালবেলা: বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর করা যায়নি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগ বিদেশ সফর হয় অপ্রয়োজনীয়। বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা না গিয়ে বিদেশ সফর করেন সরকারী আমলারা। এগুলো দেখার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। অন্তত ছয় মাস এসব বিষয়ে কঠোর নজরদারি করে অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে আমদানির কারচুপি বন্ধ করা উচিত। কারচুপি প্রকাশ্যে যা হয় আড়ালে হয় আরও বেশি। মূলধনী যন্ত্রপাতির নামে হয়তো আমদানি করছে খুব উচ্চক্ষমতার বৈদ্যুতিক পণ্য। মূলধনী যন্ত্রপাতির কর আড়াই শতাংশ সেখানে এসব পণ্যের কর ২০০ শতাংশের ওপর পর্যন্ত। এগুলো তদারকি করে তাদের ধরার মতো লোক দেশে রয়েছে। কিন্তু কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এসব কোনো একজন এককভাবে করতে পারবে না। অনেক প্রতিষ্ঠানের পার্টনারশিপে এগুলো হয়। এসব দেখার জন্য সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আন্ডার ইনভয়সিং, ওভার ইনভয়সিং এবং মানি লন্ডারিং বন্ধ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে সফল হয়েছে সুতরাং আমরাও চাইলে সেটা সম্ভব। আরেকটা বিষয় হলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ আদায় করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

কালবেলা: সরকার বলছে খেলাপি ঋণ আদায় করতে গেলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ঋণখেলাপিরা মূল উৎপাদনের সর্বোচ্চ ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন করছে। কিন্তু তাদের জন্যই বাকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা অবৈধ এবং অনৈতিক কাজ করছে অথচ তাদেরকেই সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এটা এক ধরনের সিন্ডিকেটের মতো। ঋণখেলাপিরা ছাড়া অন্য যারা রয়েছেন তারা খুব কষ্ট করে চালিয়ে যাচ্ছেন। ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনলে বাকিরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করবে। সুতরাং আমি এটা একেবারেই বিশ্বাস করি না যে- ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা একদমই খোঁড়া যুক্তি। এই যুক্তি যারা দিছেন তারা সিন্ডিকেট বন্ধ করলে বাজার নষ্ট হয়ে যাবে টাইপের যুক্তি দিচ্ছেন।

কালবেলা: প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমশক্তি যাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স কমছে। কেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স উপার্জন করছে তা বেশিরভাগ খেয়ে ফেলছে একধরনের মধ্যস্বত্বভোগীরা। রেমিট্যান্স নিয়ে কারসাজি করছে মূলত দুই-তিনটা এমএফএস আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের এজেন্টরা প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে বিদেশেই তা রেখে দিচ্ছে এবং দেশে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে রেমিট্যান্স ভোগীদের টাকা দিয়ে দিচ্ছে। এভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব এমএফএস প্রতিষ্ঠানের গার্ডিয়ান বা মুরব্বি হলো দেশের বিত্তবানরা। তারা সমাজের শক্তিশালী লোক। ফলে তাদের ওপর তেমন কোনো চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এসব এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর শক্তভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং দরকার হলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। তাতে রেমিট্যান্সের কোনো ক্ষতি হবে না বরং ভালো হবে। তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্যরাও সেটা দেখে শিখবে।

যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন এবং যারা দেশে সেই রেমিট্যান্স ভোগ করছেন তাদের ওপর যদি তদারকি করা হয় তাহলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। তদারকি করলে এই মধ্যস্বত্ব ভোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এটা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। এ ছাড়া রয়েছে হুন্ডি। বাংলাদেশের বৈধ চ্যানেলে যত রেমিট্যান্স আসে তার চেয়ে বেশি আসে হুন্ডিতে। হুন্ডিতে টাকা আসাটাও টাকা পাচার। এভাবে প্রতিবছর ব্যাপক টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও কিছু মানুষ বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠান। সুতরাং বৈধ পথে টাকা পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে ভর্তুকি দিতে হবে।

প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে অনেক সময় সমস্যার সম্মুখীন হন। কখনো কখনো তাদের অনেক দূরে যেতে হয় টাকা পাঠানোর জন্য, কারণ তাদের আশপাশে কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল উপস্থিত থাকে না। এসব ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংকগুলোর সাথে কথা বলবে যাতে ব্যাংকের এজেন্ট প্রবাসীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। দরকার হলে তারা কালেকশন পয়েন্ট স্থাপন করবে। আর প্রয়োজনে এখানেও ব্যাংককে ভর্তুকি দেবে সরকার। যারা রেমিট্যান্স পাঠাবেন তাদের সবার ঠিকানা এম্বাসিগুলোতে রয়েছে। সুতরাং ব্যাংকের এজেন্ট তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা খুব কঠিন কিছু নয়। তারা প্রবাসীদের কাছে গিয়ে দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করবেন। এখানে আরও একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংককে। সেটা হল রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীরা যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়।

আমি আশঙ্কা করি, আগামী পাঁচ বছর পর তৈরি পোশাক থেকে আমাদের রপ্তানি আয় কমে আসবে। আর সেক্ষেত্রে রেমিট্যান্স আমাদের জন্য অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়বে। এখন যারা বিদেশে যাচ্ছেন তারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তাদের দেশপ্রেম অনেক বেশি এবং দেশে রেখে যাওয়া পরিবারের প্রতি তাদের টান অনেক বেশি। ফলে অবশ্যই তারা দেশে টাকা পাঠাবেন। সুতরাং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রেমিট্যান্সের অবদান ধরে রাখতে হলে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

কালবেলা: অর্থনৈতিক সমস্যা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করায় বেশিরভাগ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কি সঠিক রোল প্লে করতে পারছে বলে আপনি মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: এখানে সবকিছুই শুধুম বাংলাদেশ ব্যাংকের একক দায়িত্ব না। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির ও দায়িত্ব রয়েছে। ব্যাংক এবং এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো মিনিস্ট্রির অধীনে। মানি লন্ডারিং যারা করছে সেটা খুঁজে বের করতে পারে সরকারের যে ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি। সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তো দায়িত্ব নিতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় রয়েছে কিন্তু সেটা একক দায় নয় বলে আমি মনে করি।

সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব কার সেই প্রশ্নে আমি বলব, সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব হলো এনবিআরের । এনবিআর ইচ্ছে করলে একাই অনেক কিছু করতে পারে। আমার নিজের চোখে দেখা, আমদানি হওয়ার কথা ক্যাপিটাল গুডস সেখানে আমদানি হয়েছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্র। অবৈধভাবে তারা এই পণ্য নিয়ে এসেছে এবং এর সরকারি ট্যাক্স অনেক বেশি। এনবিআর অফিসারের কাছে সেটা ধরা পড়েছে এবং সেই অফিসার কে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এভাবে তো তারা কাজ করতে পারবে না। তাদেরকে তো কাজ করার সুযোগ দিতে হবে এবং তাদেরকে তো নির্ভয় দিতে হবে।

সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি আমাদের দেশ এখন সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এটাতো এমনি এমনি হয়ে যায়নি। অনেক যোগ্য এবং সৎ ব্যক্তি ও অফিসার রয়েছে। তাদেরকে সঠিক জায়গায় এনে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে।

কালবেলা: বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কি ব্যাংকিং ক্রাইসিসের কারণে তৈরি হয়েছে?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ব্যাংকের একটি ভালো দিক স্বীকার করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিটা যেভাবে ব্লো আপ করেছে সেখানে ব্যাংকের বড় অবদান রয়েছে। ব্যাংকের ক্যাপাসিটি যেভাবে গ্রো করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাপাসিটি সেভাবে বেড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে ব্যাংক যে ক্ষতিটা করেছে- প্রাইভেট ব্যাংকের যে কার্টেলটা তৈরি হয়েছে তারা এতটাই আসকারা পেয়েছে যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংককের ক্যাপাসিটি আরও বৃদ্ধি করে আপামর মানুষের সুবিধায় ব্যাংককে কাজে লাগাতে হবে। দেশের অর্থনীতির সার্বিক স্বার্থে একটি অর্থ কমিশন গঠন করতে হবে। অর্থ কমিশনের প্রধান হবেন এমন ব্যক্তি যিনি কোনো দল বা মত দ্বারা প্রভাবিত নন। যিনি কারো ভয়ে ভীত হবেন না। যিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিবেন। এভাবে এগোলে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন নয়।

কালবেলা: দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপানোর কোনো ভূমিকা আছে কি?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ দেওয়া। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাপক পরিমাণ ঋণ নিয়েছে যার ফলে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের বাজার পর্যন্ত তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিত্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে যেকোনোভাবেই হোক এর বিকল্পগুলোকে ব্যবহার করা। সরকার পেনশন স্কিম থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারে, সঞ্চয়পত্র থেকে টাকা সংগ্রহ করতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেও টাকা নিতে পারে। কিন্তু অবশ্যই টাকা ছাপানো বন্ধ করা উচিত।

এখানে পেনশন স্কিম খুব ভালো একটি সমাধান। কল্যাণ রাষ্ট্রে এটা খুবই জরুরি। পেনশন স্কিম চালু করায় এখান থেকে কোনো ধরনের মূল্যস্ফীতি ছাড়াই সরকার খুব সহজে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে এবং যাদের কল্যাণ হওয়ার কথা তারা কল্যাণপ্রসূর মধ্যে চলে যাবে। বাংলাদেশের পেনশন স্কিন চালু করা খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কিন্তু এমন একটি সময়ে এটি চালু করা হয়েছে যখন দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপরে মানুষের খুব একটা আস্থা নেই।

বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। এর বাইরে আছে টাকাওয়ালা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা অনেকেই বিদেশে টাকা পাচার করছেন, দেশ লুণ্ঠন করছেন। আমরা বেগম পাড়ার কথা শুনি, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার গর্জন শুনি আমরা বেগম পাড়ায় অমুক পাড়ায় রেড করব। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বেশ উচ্চবাচ্য করছে। এই সময়টায় যদি সরকার তাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে, সরকার যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চায় তাহলে এখন খুব সহজেই এসব বেগম পাড়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকি পাচার হওয়া এসব টাকা ফেরত আনাও সম্ভব।

তারেক জিয়ার টাকা আমরা ফেরত নিয়ে আসছি একটা উদাহরণ তৈরি হয়েছে। এটাকে উদাহরণ ধরে আমরা অন্যান্য পাচারকারীদের টাকাও ফেরত আনছি না কেন? আমি বারবার বলি- যারা সিস্টেমটাকে দুমড়েমুচড়ে লাভবান হচ্ছে, উইন্ড ফল করছে তাদের সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। তাদের সংখ্যা শতকরা ৫-১০ ভাগের বেশি না। এই স্বল্পসংখ্যক অসৎ ব্যক্তিকে যদি নিয়মনীতির আওতায় আনা যায় তাহলে দেশের বাকি ৯০ ভাগ মানুষ অনেক খুশি হবে। তারা তখন দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করবে। আমি নিশ্চিত সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের অর্থনীতির এই সংকট সমাধান করতে তিন মাস সময় লাগবে এবং সেখান থেকে তরতর করে ওপরের দিকে যেতে একদমই সময় লাগবে না।

কালবেলা: বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে কেমন দেখছেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: জনগণই বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়কে আমরা খুঁজে পাই না। এটা তো মিথ্যা নয়। আগে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ অনেক দৃশ্যমান ছিল। অর্থমন্ত্রী এমনকি এই মন্ত্রণালয়ের সচিব অনেক দৃশ্যমান ছিলেন। এখন সেটা নেই। সরকারের কেউ কেউ বলেন- যারা বলে অর্থনীতির অবস্থা ভালো না তারা অশিক্ষিত। এটা ঠিক না। আমি অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছি, অর্থনীতির বড় বড় পণ্ডিতরাও কখনো এ ধরনের কথা বলেন না। সরকারের জনবলের কোনো অভাব নেই। কিন্তু কে কান্ডারি হবেন, কার হাতে নিশান থাকবে, কী পলিসি গ্রহণ করবেন; সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করারই অভাব দেখছি।

আমি ট্যাক্স-জিডিপির রেশিওর কথা অনেক বলেছি। দেশে প্রচুর টাকা রয়েছে। কিন্তু সরকারের টাকা ওঠানোর ক্ষেত্র নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। এটা পলিসিগত সমস্যা। যেখানে আড়াই কোটি মানুষের আয়কর দেওয়া উচিত সেখানে আয়কর দিচ্ছে মাত্র ৩০ লাখ লোক।

কালবেলা: বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেটা কি আমাদের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমি মনে করি দেশে যদি কোনো ধরনের সংঘাত হয় তবে এর পরবর্তীতে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ হবে। এমনিতেই আমরা খুবই কঠিন রাস্তার মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি। আর সেখানে যদি রাজনৈতিক সংকটার সমাধান না হয় তাহলে এই অর্থনৈতিক সংকটটি আরও প্রকট হবে। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে পারেন যে মধ্যমপন্থি ব্যক্তিবর্গ তাদেরকেও অমুক ঘরানার তমুক ঘরনার করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে মধ্যস্থতা করার সুযোগ নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। আর সেখানে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের পরাশক্তি গুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান। আমরা এতদিন সকলের সাথে একটি ব্যালেন্স করে চলেছি। সামনেও আমাদের ব্যালেন্স করেই চলতে হবে। আর এক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিমানে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে ট্রাম্প প্রশাসন

পারভেজ হত্যায় গ্রেপ্তার টিনা, ৫ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ

আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের গাড়িবহরে হামলা

ভারতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা, অস্বীকার পাকিস্তানের

পাকিস্তানে আরেকটি ভারতীয় ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত

‘৯ মাসেও গণহত্যাকারী দল নিষিদ্ধ হলো না কেন’

বাদ জুমা বড় জমায়েতের ডাক হাসনাত আবদুল্লাহর

এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা / নিহত ৪ জনের দুজন ছিলেন মসজিদের ইমাম

রাতে শিবির মাঠে নামায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট

যমুনার সামনে রাতভর যা যা হলো

১০

কয়টি রাফায়েল আছে ভারতের, একেকটির দাম কত?

১১

ফের গোলাগুলি শুরু, উত্তেজনা তুঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে

১২

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে নাক গলাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র

১৩

দুপুরের মধ্যেই আ.লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ড. মাসুদের

১৪

সকালেও বিক্ষোভ চলছে যমুনার সামনে

১৫

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে কোমলমতি শিশুরা

১৬

আগুনে ঘি ঢালা নয়, শান্তি চাই : এরদোয়ান

১৭

শুক্রবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৮

আরব সাগরে ভারতের অভিযান, টার্গেটে পাকিস্তান

১৯

০৯ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

২০
X