ড. সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক। দেশের বর্তমান অর্থনীতির অবস্থা ও রাজনীতির উত্তাপ অর্থনীতিতে কতটা পড়বে, তা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা।
কালবেলা: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অর্থনীতির ওপর নতুন কোনো চাপ সৃষ্টি করবে কি?
ড. সেলিম রায়হান: আমাদের অর্থনীতি যে কিছু সংকটের মধ্যে রয়েছে, সেটি নিয়ে কেউ দ্বিমত করবে না। এই সংকটের মধ্যে আবার যদি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়, সেটা আমাদের জন্য শুভ হবে না। হরতাল এবং অবরোধকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও স্থবির হয়ে পড়লে অবশ্যই সেটা আমাদের অর্থনীতির ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে। অনেকের মতো আমি নিজেও উদ্বিগ্ন। ঠিক এই সময়ে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ আমরা কতটুকু নিতে পারব সেটা নিয়ে আমি শঙ্কিত। এমনিতেই আমরা অনেক বড় ধরনের মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে আবার যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এই অজুহাতে যদি আবারও পণ্যের দাম বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করা হয় সেটা ভয়ংকর হবে। সুতরাং একটা উদ্বেগের জায়গা আমাদের সামনে রয়েছেই।
কালবেলা: দেশের রাজনৈতিক এই অস্থিরতার মধ্যে অর্থনীতিকে সচল রাখতে আমাদের কী করণীয় বলে মনে করেন?
ড. সেলিম রায়হান: বাংলাদেশে একটা দীর্ঘ সময় আমরা এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখিনি। রাজনৈতিক এই সংকট এবং সংঘর্ষ যদি দীর্ঘায়িত হয়, যদি কোনো সমাধান না আসে তাহলে অর্থনীতিতে একটি বড় অনিশ্চয়তার জায়গা সৃষ্টি হবে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে কয়েকবার ভাববেন। কর্মসংস্থানসহ সবকিছুতেই সেটার একটি প্রভাব পড়বে। অতীতেও এই ধরনের রাজনৈতিক সংকট এবং সহিংসতার মধ্যে পড়েছিল বাংলাদেশ। সেসব সময়েও কোনো না কোনোভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। সুতরাং আমি আশা করব, রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটা সে ধরনের কোনো সংঘাতের দিকে যাবে না। সকলের প্রত্যাশা দুপক্ষ একটি ইতিবাচক সমাধানের দিকে যাবে।
কালবেলা: বাংলাদেশ এখন যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করছে, সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায় কী?
ড. সেলিম রায়হান: অর্থনীতির গভীর সংকটের মূলে এখন রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। দীর্ঘদিন ধরে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপগুলো নেওয়ার প্রয়োজন ছিল সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। সময়মতো আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে মুদ্রানীতি আমাদের প্রয়োজন ছিল, সেটা করা হয়নি। রাজস্ব নীতিও বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল যেটা করা হয়নি। প্রয়োজনে কর ছাড় দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা যেত। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রানীতির যে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় বড় ধরনের নৈরাজ্য রয়েছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বাজারে পণ্যের মূল্যেকে অবৈধভাবে বাড়িয়ে দেয়। এ কারণেই পণ্যের উচ্চমূল্য থেকে যায় দীর্ঘ সময় ধরে। একবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে এই মূল্য আর কমে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে এই বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতি। গত প্রায় দুই বছর ধরে আমরা দেখছি প্রতিমাসে গড়ে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার করে রিজার্ভ কমছে। এটিও ঘটেছে আমাদের ভ্রান্ত নীতির কারণে। কৃত্রিমভাবে ডলারের রেট ধরে রাখার একটি চেষ্টা করা হয়েছে। সে কারণে বাজারে রিজার্ভ কমিয়ে ডলারের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা যদি বাজারমুখী করা না যায় তাহলে এই রিজার্ভের পতন আরও সামনের দিকে যাবে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে রয়েছে এক ধরনের সংকটে। ঋণখেলাপি চরম মাত্রায়। আর্থিক খাতে এই ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্বলতা নিয়ে অর্থনীতির বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়। রাজস্ব আদায়ে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন ট্যাক্স জিডিপির রেশিও দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। গত এক দশকেও এর কোনো উন্নতি নেই। এই সব বিষয় আমাদের অর্থনীতির এক একটি গভীর ক্ষত। অবশ্যই আমাদের এগুলো সমাধান করতে হবে। এই সকল সংকটের পাশাপাশি যদি রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয় তাহলে তা অর্থনৈতিক সংকটের ওপর নতুন করে একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। সমস্যাগুলো তখন সমাধান হওয়ার পরিবর্তে আরও বেশি ঘনীভূত হবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের একটি বড় জায়গা রয়েছে।
কালবেলা: আপনি যে সংকটগুলোর কথা বললেন তার পেছনেও কি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে?
ড. সেলিম রায়হান: এই সকল সংকটের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অর্থনীতি। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং সঠিক নীতি গ্রহণ করতে না পারার কারণেই এখনকার এই মূল্যস্ফীতি আমরা দেখছি। যারা আমাদের নীতি নির্ধারণ করেন তারা নিজেরাই সমস্যার সমাধান করতে চান না। এখানে অবশ্যই তাদের এক ধরনের স্বার্থ রয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার ৯ ও ৬ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেটা অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কোনো একটা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছে। তারা কম সুদে ঋণ নিতে পেরেছে। আমাদের ঋণখেলাপির যে ভয়ংকর অবস্থা সেটি অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়েছে। তারা ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে কিন্তু ঋণ ফেরত দেয়নি। ব্যাংক খাতে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। দেশের কর আদায়ের ক্ষেত্রে সফলতা নেই কেন? কারণ সেখানেও একটি গোষ্ঠী সুবিধা পেয়েছে। যারা এই সকল সিস্টেমগুলো থেকে সুবিধা পাচ্ছে তারা সংস্কারের ঘোর বিরোধী। আর এই গোষ্ঠীগুলো যেমন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী তেমনি কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক প্রভাবশালী শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবেই তারা নানা ধরনের সমর্থন পেয়ে আসছে। সংস্কারবিরোধী গোষ্ঠী খুবই শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা আমরা দেখেছি তা আসলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রকাশের ব্যর্থতা।
কালবেলা: যে গোষ্ঠীটি সুবিধা পেয়েছে তারা কি রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধান হোক তা চায় না?
ড. সেলিম রায়হান: একটা বিষয় আমাদেরকে খেয়াল করতে হবে, এই গোষ্ঠীর অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ হয়েছে। আমরা রাজস্ব হারিয়েছি, কর থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সংস্কারবিরোধী এই গোষ্ঠীটি যদি প্রবল প্রতাপে থাকতে পারে তাহলে অবশ্যই এ দেশের অর্থনীতি আরও খারাপের দিকে যাবে। অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সত্যিকারের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা যদি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অন্যন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই তাহলে অবশ্যই এই অসাধু গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অবশ্যই দ্রুত সংস্কার কর্মসূচি শুরু করতে হবে এবং তা খুব শক্তিশালীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যখন সংস্কার কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে তখন এই গোষ্ঠীটি বাধা প্রদান করবে। তাদের সেই বাধা অতিক্রম করার জন্য সে রকম রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তা না হলে সংস্কার কোনোদিনই সম্ভব হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা যেমন পূরণ করতে পারব না তেমনি এই মুহূর্তে আমরা যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছি সেটা থেকেও বের হতে পারব না। এখনকার এই অর্থনৈতিক সংকটের একটি বড় কারণ হচ্ছে, অবৈধ সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পাওয়া অন্যায্য সুবিধাগুলো। এই গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি গভীর সংকটের মুখে পড়েছে।
কালবেলা: দেশের রাজনৈতিক সংকটের পেছনেও কি তাদের কোনো ভূমিকা রয়েছে?
ড. সেলিম রায়হান: সেটা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারব না। তবে আমি মনে করি, আমাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সমাধান জরুরি। দেশের ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন।
শ্রুতলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন