সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে এই লিখনীর অবতারণা করছি। ঈদ মানে খুশি বা আনন্দ। দুনিয়াজুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এর একটি ঈদুল ফিতর, আর অন্যটি ঈদুল আজহা, যাকে কোরবানির ঈদও বলা হয়। বাংলাদেশের মুসলমানরা সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করেন ঈদুল ফিতরকে এবং এক কথায় সবার কাছে পরিচিত ঈদ হিসেবে। এই সময়টিতে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে- অর্থাৎ সারা বছরে যত পণ্য আর সেবা কেনাবেচা হয়, তার বড় অংশটি হয় এই সময়ে।
ঈদ ইসলামের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলেও এই ধর্মের আবির্ভাবের সাথে সাথেই কিন্তু ঈদের প্রচলন শুরু হয়নি। ঈদুল আজহা কখন আর কোন প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। কিন্তু ঈদুল ফিতর কখন আর কিভাবে প্রচলিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে তথ্য কমই জানা যায়।
ইসলামের ইতিহাসবিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে যে ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল। নবী মুহাম্মদ যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সময়কে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরি সাল গণনা শুরু করা হয়েছিল আরও ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের সময়ে।
এরপর হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেওয়া হয় যে রমজান মাস- চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনেও শেষ হতে পারে - শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে।
এ বিষয়ে আনাস নামে নবী মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা করা একটি হাদিসের উদ্ধৃতি অনুযায়ী, মদিনায় যাওয়ার পর নবী দেখলেন, সেখানকার মানুষ বছরে দুটি বড় উৎসব পালন করে। তিনি তখন জানতে চান, সেগুলো কী উৎসব? এগুলো ছিল নওরোজ এবং মিহিরজান নামে দুটি উৎসব - যেগুলো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হত।
ঈদ উদযাপন মদিনায় শুরু হলেও পরবর্তীতে পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয়ে যায় ঈদ পালন। কালক্রমে অঞ্চল ভেদে এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়।
ইতিহাসবিদ বলেছেন, ১৫০ বছর আগেও এ অঞ্চলে সাধারণের মধ্যে ঈদ তেমন বড় কোন উৎসব ছিল না। তাদের মতে ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর সময় বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদযাপনের চল শুরু হয়। উনিশ শতকের গোঁড়ার দিকে যখন এ অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন ঈদ পালনও বাড়তে থাকে বলে উল্লেখ করা হয় বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায়। এক সময় দিল্লির মুঘলদের অনুকরণে ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো। ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমানে ঈদ যেমন ব্যাপক উৎসবের আকার পেয়েছে, তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হবার পর - যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিস্তৃত হতে থাকে। তার আগে, ঈদ উদযাপনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা। আনুষ্ঠানিকতার প্রায় পুরোটাই ছিল ঢাকা-কেন্দ্রীক, যে কারণে ঐতিহাসিক বর্ণনায় ঢাকার ঈদ সম্পর্কেই জানা যায়।
এবার আমার বাল্যকালের ঈদুল ফিতর নিয়ে কিছু স্মৃতি রোমন্থন করা যাক। বাল্যকালে অন্যান্যর ন্যায়, আমার বন্ধু ও সমবয়সী আত্মীয়স্বজনেরাও ঈদের নতুন জামা কাপড় নিয়ে মেতে থাকতো। আমি এর ব্যতিক্রম ছিলাম। আমার যত বায়না ছিল খেলাধুলার উপকরণ নিয়ে। আমার শ্রদ্ধেয় মরহুম বড় ভাই তখন ঢাকায় সরকারি চাকরি করতো। বাবার অফিসের টেলিফোনে একবার আমাকে জিজ্ঞাস করল, এই ঈদে তোমার জন্য কি নিয়ে আসব। আমি বললাম ফুটবল, হেসে জিজ্ঞেস করল কি বল, আমি বললাম ডিয়ার বল। ওই সময় ডিয়ার লেখা ফুটবল খুব জনপ্রিয় ছিল। ঈদের দিন সকালে আমার কাঙ্ক্ষিত ফুটবল টি প্রথম শর্ট মারতেই, মান্দার গাছের কাটায় বৃদ্ধ হয়ে পাঞ্ছার হয়ে গেল, কাটাবিদ্ধ হয়ে বাতাস বের হয়ে গেল। আমাদের গ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় এই কাটাযুক্ত গাছকে মান্দার গাছ বলা হয়। এবার আমি রেগে মেগে কেঁদে, বলটি কেটে কয়েক টুকরো করে ফেললাম। আমার কষ্ট এবং কান্না দেখে, আশপাশের অনেকের ঈদ মাটি হয়ে গেল। অনেকে কান্না শুরু করলো। কোন এক অদৃশ্য কারণে হয়তো আমার পরিবার এবং পাড়া প্রতিবেশী আমাকে একটু বেশি আদর করত। সেজন্য সবাই আমাকে নিয়ে মেতে থাকত, একের পর এক সবাই এসে সান্তনা দিতে লাগলো। আমি বিরক্ত হয়ে শীতকাল হওয়ায় কম্বল মুড়ি দিয়ে সে কী ঘুম।
বাল্যকালে প্রায় প্রতি ঈদে আমার পকেট হতে টাকা হারাতো। কারণ ঈদগাহ মাঠ হতে স্থানীয় বাজার পর্যন্ত আমি সবার সঙ্গে মুলাকাত এবং খুনসুটিতে মেতে থাকতাম। কখনোই রাস্তাঘাটে ও বাজারে দোকান হতে খাবার দাবার খেতে পছন্দ করতাম না। বাসায় এসেই দেখতাম পকেটে টাকা নাই। প্রায় ঈদের দিন এমন হওয়ায়, একটা সময় অবশ্য মা সকালেই পকেট হতে আমার টাকা নিজ হেফাজতে রাখতেনা। বাসায় এসে পকেটের টাকা খুঁজতেই মা হাসাহাসি করত, পরে অবশ্য দিয়ে দিত। কয়েক বছর আগেও, আমার বয়সে বড় চাচাতো বোন আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। হাসার কারণ জানতে চাইলে বোন বলল, ঈদের দিন ও দুপুর বেলায় জ্যেঠা তোকে শীতকালে গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে পড়াতে বসতো, বিষয়টি আমাদের খুব বিরক্ত লাগতো, এইজন্য তোকে দেখে হাসতেছি।
বাল্যকালে একটা বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকতো, অনেক সময় ঈদের দিনও। কারণ আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আটটা বিদ্যালয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। বাবা সরকারি চাকরি করতো, যেখানে ট্রান্সফার হতো, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। শিশুকালে গ্রামে কিছুদিন থাকলেও ওই সময় ৩টা বিদ্যালয় পরিবর্তন করা অলরেডি শেষ। বিদ্যালয-গুলিতে কিছুদিন অতিবাহিত করা মাত্রই আমার সঙ্গে অনেকের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যেত। আমি স্কাউট বিএনসিসি আন্ত বিদ্যালয় টুর্নামেন্ট এবং ডিবেটিং এর সঙ্গে জড়িত থাকতাম। এ কারণে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে দিন কয়েক এর মধ্যেই সুসম্পর্ক তৈরি হতো। তখন মোবাইল ইন্টারনেটের যুগ না থাকায়, অধিকাংশকে পরবর্তী জীবনে আর খুঁজে পেতাম না। মনে পড়লেই ঈদের দিনও আমার কান্না আসতো। অধিকাংশকে আর কখনো খুঁজে পাই নাই।
কোন এক ঈদের আনন্দের মধ্যে আমার জীবনে বিষাদ নেমে আসে। আমি দিনাজপুরের হিলি বন্দরের পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জের দাউদপুর ডিগ্রি কলেজে মাদক বিরোধী কনসার্ট করেছিলাম। কনসার্টে স্থান পাওয়া একটি লোকসংগীত আমার এখনো মনে পড়ে। গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। কর্মসূচি শেষ করে আমি ঢাকা হয়ে সিলেট গমন করি। সিলেট হতে মাদক কারবারীরা আমাকে অপহরণ করে ভারতে নিয়ে যায়।
এবার রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন সংগঠনের অগণিত নেতাকর্মী ও সমর্থক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রমজানে মায়ের হাতের ইফতার তাদের ভাগ্যে জোটে নাই। পবিত্র ঈদুল ফিতর এর দিনেও মায়ের হাতে সেমাই মিষ্টি চটপটি ফিন্নি ফালুদা হতে তারা যেন বঞ্চিত না হয়। সবাই নির্বিঘ্নে নিজগৃহে পরিবারের সঙ্গে যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। এই ব্যবস্থাটি করার জন্য বাংলাদেশ সরকার, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ঈদের সময় ও পক্ষ-বিপক্ষ তকমা দিয়ে কারো উপর যেন হামলা করা না হয়। মনে রাখতে হবে জীবন রক্ষা করা সবার অগ্রাধিকার। তারপর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান চিকিৎসা ও শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। আমি আশাবাদী এই ঈদে মৌলিক অধিকার হতে কেউ বঞ্চিত হবে না। কারণ বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছেন একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী।
ঈদুল ফিতর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ উপলক্ষে আমার জন্য যে কর্মসূচি সাজানো হয়েছে, উহা পর্যালোচনা করে দেখলাম, এবার ঈদেও প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে আমার ঈদ উদযাপন করা হচ্ছে না। কারণ ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল এর আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে হবে। ঈদ ৩১ মার্চ হলে, আমার ঈদ চেন্নাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে/সংলগ্ন স্থানে উদযাপন করতে হবে। আর যদি পহেলা এপ্রিল হয়, তবে আমার ঈদ-উল ফিতর শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে উদযাপন করতে হবে।
আসুন এবার ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিই। পোশাক আশাকের এই সস্তার জমানায় কেউ যেন ঈদুল ফিতরের দিন পুরোনো জামা কাপড় পড়তে না হয়। আসুন অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিগণ দেরি না করে, এখনোই পার্শ্ববর্তী ঘর বাড়ি পাড়া ও মহল্লায় খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি। পরিশেষে এই কামনাই রইল, তাপসী ও আছিয়াসহ সবার ঘরে পৌঁছে যাক ঈদুল ফিতরের আনন্দ। যারা তুচ্ছ কারণে জর্জরিত। কেউ বা বিনা দোষে শকুনের রোষানলে পড়ে অকালে জীবন দিয়েছে। তারা যেন না ফেরার দেশে ভালো থাকে।
লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
মন্তব্য করুন