বাবা শব্দটি ছোট হলেও এর ব্যাপ্তি বিশাল।
বাবা হচ্ছেন সেই নীরব সৈনিক, যিনি দিনের পর দিন লড়াই করে যান শুধুই সন্তানের মুখের হাসির জন্য। তারা হয়তো সবসময় পাশে বসে গল্প শোনান না, কিন্তু তাদের ঘামে গড়ে ওঠে আমাদের ভবিষ্যতের ভিত। অথচ এই বাস্তবতাটা আমরা তখনই বুঝতে পারি, যখন বাবার অস্তিত্বটা হারিয়ে যায়, বা তিনি নীরবে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যান।
আমার নিজের কথাই বলি।
আমি এখন বাবা। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিজেকে প্রশ্ন করি- আমি কি পারছি আমার সন্তানের মাথার ওপর সেই ছায়াময় বটবৃক্ষ হতে?
আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ চা দোকানি। অনেকের কাছে যেটা নস্যি, আমার কাছে সেটা ছিল গর্বের প্রতীক। কারণ তার হালাল রুজির মাধ্যমে চলতো আমাদের বড় সংসার। আমি তখন খুব ছোট, স্কুলেও ভর্তি হইনি। কিন্তু বাবার প্রতি ভালোবাসা ছিল অনেক গভীর।
রাত গভীর হলে আমি ঘুমের ভান করে থাকতাম। জানতাম, বাবা বাড়ি ফিরবেন- হয়তো নিয়ে আসবেন একটু মিষ্টি, এক গ্লাস দুধ বা একটা পাউরুটি। আর তারপর শুরু হতো ‘আদর্শলিপি’ পড়া। ঘুম জড়ানো চোখে কিন্তু একটুও বিরক্ত না হয়ে বাবার কণ্ঠে উচ্চারিত অক্ষরগুলো গিলতাম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে।
সেই মানুষটিই আমাকে শিখিয়েছেন- জীবনে কখনো তর্কে জড়াতে নেই। শান্ত থেকে, নিজের অবস্থান থেকে পরিবার, সমাজ- সব কিছুতেই অবদান রাখা যায়।
আজ বাবা নেই। মা-ও নেই।
শুধু থেকে গেছে কিছু অমলিন স্মৃতি, আর চোখ ভেজা আক্ষেপ- “একবারও জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি, বাবা আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি!”
আজ এ শব্দগুলো বুকের ভিতর জ্বলতে থাকে, পোড়াতে থাকে।
তাই তো এখন যখন কেউ ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করে, আমার চোখ অকারণেই ঝাপসা হয়ে আসে। ভারী হয়ে ওঠে বুক।
আমরা অনেকেই মনে করি, আমরা নিজে নিজেই বড় হয়েছি। চাকরি, পদ, অর্থ- সবকিছুর পেছনে ছুটতে গিয়ে ভুলে যাই, আমাদের আজকের সফলতার বীজ রোপণ করেছিলেন বাবা নামের সেই সাধক। আর তার চাষাবাদ করে গেছেন মা।
তবে আজকের সমাজে অনেক সন্তান আছেন, যারা শুধু বাবার শ্রমকে আত্মসাৎ করেছেন, অথচ বাবার অসুস্থতা বা বৃদ্ধ বয়সে পাশে থাকেননি। কেউ কেউ আবার বাবা-মাকে পাঠিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে- যেখানে জীবনের শেষ সময়টা পার করেন একাকিত্বে, অভিমান আর নিঃশব্দ অশ্রুতে।
আমার দেখা একটা ঘটনা আজও মনকে নাড়িয়ে দেয়। একজন বাবা, যিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ, হঠাৎ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।
ডাক্তার জানান, তার শরীরে একটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন না হলে তিনি বাঁচবেন না। পরিবারে হতাশা। স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র- সবার মাথায় অন্ধকার নেমে আসে।
তখন পরিবারের এক কন্যা সাহস করে দাঁড়ায়।
সে জানায়, ‘আমার ভবিষ্যৎ তখনই অর্থবহ, যখন আমার মাথার উপর বাবা নামের ছায়াটি থাকবে। বাবা যদি না থাকেন, তবে সেই ভবিষ্যৎ আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাঁচতে চাই বাবার পরিচয়ে, বাবার আশ্রয়ে।’
কেউ রাজি হয় না। মা কাঁদে। সমাজ ভয় দেখায়। আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবুও মেয়েটির জেদ নড়েনি। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয় বাবার শরীরে।
দিন যায়, সময় বদলায়। চিকিৎসার পর বাবা সুস্থ হন। মেয়েটিও সুস্থ হয়। তাদের জীবন আবার হাসে। নষ্ট সময় ফিরিয়ে আনা যায় না ঠিকই, কিন্তু তাদের সেই আত্মত্যাগপূর্ণ মুহূর্তগুলো হয়ে যায় সব সন্তানের জন্য এক উদাহরণ, এক অনুপ্রেরণা।
আজ যখন কেউ বলে, ‘সব সন্তান খারাপ’, আমি বলি, না। এখনো কিছু সন্তান আছেন, যারা বাবার জীবনের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখেন।
যারা বোঝেন- পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত আশ্রয় হলো বাবার সেই নীরব ভালোবাসার ছায়া।
আজ এই গল্পটি লিখছি এই বিশ্বাস নিয়ে— জীবনের সব কিছুর উৎস যে মানুষটা, তিনি আমাদের বাবা। তাকে ভালোবাসা, তাকে সম্মান করা, তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আর যারা হারিয়ে ফেলেছেন- তারা যেন অন্তত স্মৃতির পাতায় সেই ছায়ার তলে ফিরে যান।
ভালো থাকুন পৃথিবীর সব বাবা। ভালো থাকুক সেই সন্তানরা, যারা এখনো বাবার আশ্রয়কে শ্রেষ্ঠ আশ্রয় বলে মনে করেন।
যে ছায়ায় মানুষ হই, সে ছায়া হারানোর আগেই বারবার বলে ফেলি— “বাবা, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি!”
লেখক : রফিক সরকার, গণমাধ্যমকর্মী
মন্তব্য করুন