শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫, ২৬ আশ্বিন ১৪৩২
রফিক সরকার
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৫, ০৫:৩৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

‘বটবৃক্ষের ছায়ায়’

বাবা-ছেলের যুগলবন্দি। ছবি : সংগৃহীত
বাবা-ছেলের যুগলবন্দি। ছবি : সংগৃহীত

বাবা শব্দটি ছোট হলেও এর ব্যাপ্তি বিশাল।

বাবা হচ্ছেন সেই নীরব সৈনিক, যিনি দিনের পর দিন লড়াই করে যান শুধুই সন্তানের মুখের হাসির জন্য। তারা হয়তো সবসময় পাশে বসে গল্প শোনান না, কিন্তু তাদের ঘামে গড়ে ওঠে আমাদের ভবিষ্যতের ভিত। অথচ এই বাস্তবতাটা আমরা তখনই বুঝতে পারি, যখন বাবার অস্তিত্বটা হারিয়ে যায়, বা তিনি নীরবে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যান।

আমার নিজের কথাই বলি।

আমি এখন বাবা। কিন্তু মাঝে মাঝেই নিজেকে প্রশ্ন করি- আমি কি পারছি আমার সন্তানের মাথার ওপর সেই ছায়াময় বটবৃক্ষ হতে?

আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ চা দোকানি। অনেকের কাছে যেটা নস্যি, আমার কাছে সেটা ছিল গর্বের প্রতীক। কারণ তার হালাল রুজির মাধ্যমে চলতো আমাদের বড় সংসার। আমি তখন খুব ছোট, স্কুলেও ভর্তি হইনি। কিন্তু বাবার প্রতি ভালোবাসা ছিল অনেক গভীর।

রাত গভীর হলে আমি ঘুমের ভান করে থাকতাম। জানতাম, বাবা বাড়ি ফিরবেন- হয়তো নিয়ে আসবেন একটু মিষ্টি, এক গ্লাস দুধ বা একটা পাউরুটি। আর তারপর শুরু হতো ‘আদর্শলিপি’ পড়া। ঘুম জড়ানো চোখে কিন্তু একটুও বিরক্ত না হয়ে বাবার কণ্ঠে উচ্চারিত অক্ষরগুলো গিলতাম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে।

সেই মানুষটিই আমাকে শিখিয়েছেন- জীবনে কখনো তর্কে জড়াতে নেই। শান্ত থেকে, নিজের অবস্থান থেকে পরিবার, সমাজ- সব কিছুতেই অবদান রাখা যায়।

আজ বাবা নেই। মা-ও নেই।

শুধু থেকে গেছে কিছু অমলিন স্মৃতি, আর চোখ ভেজা আক্ষেপ- “একবারও জড়িয়ে ধরে বলতে পারিনি, বাবা আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি!”

আজ এ শব্দগুলো বুকের ভিতর জ্বলতে থাকে, পোড়াতে থাকে।

তাই তো এখন যখন কেউ ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করে, আমার চোখ অকারণেই ঝাপসা হয়ে আসে। ভারী হয়ে ওঠে বুক।

আমরা অনেকেই মনে করি, আমরা নিজে নিজেই বড় হয়েছি। চাকরি, পদ, অর্থ- সবকিছুর পেছনে ছুটতে গিয়ে ভুলে যাই, আমাদের আজকের সফলতার বীজ রোপণ করেছিলেন বাবা নামের সেই সাধক। আর তার চাষাবাদ করে গেছেন মা।

তবে আজকের সমাজে অনেক সন্তান আছেন, যারা শুধু বাবার শ্রমকে আত্মসাৎ করেছেন, অথচ বাবার অসুস্থতা বা বৃদ্ধ বয়সে পাশে থাকেননি। কেউ কেউ আবার বাবা-মাকে পাঠিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে- যেখানে জীবনের শেষ সময়টা পার করেন একাকিত্বে, অভিমান আর নিঃশব্দ অশ্রুতে।

আমার দেখা একটা ঘটনা আজও মনকে নাড়িয়ে দেয়। একজন বাবা, যিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ, হঠাৎ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।

ডাক্তার জানান, তার শরীরে একটি অঙ্গ প্রতিস্থাপন না হলে তিনি বাঁচবেন না। পরিবারে হতাশা। স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র- সবার মাথায় অন্ধকার নেমে আসে।

তখন পরিবারের এক কন্যা সাহস করে দাঁড়ায়।

সে জানায়, ‘আমার ভবিষ্যৎ তখনই অর্থবহ, যখন আমার মাথার উপর বাবা নামের ছায়াটি থাকবে। বাবা যদি না থাকেন, তবে সেই ভবিষ্যৎ আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাঁচতে চাই বাবার পরিচয়ে, বাবার আশ্রয়ে।’

কেউ রাজি হয় না। মা কাঁদে। সমাজ ভয় দেখায়। আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবুও মেয়েটির জেদ নড়েনি। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয় বাবার শরীরে।

দিন যায়, সময় বদলায়। চিকিৎসার পর বাবা সুস্থ হন। মেয়েটিও সুস্থ হয়। তাদের জীবন আবার হাসে। নষ্ট সময় ফিরিয়ে আনা যায় না ঠিকই, কিন্তু তাদের সেই আত্মত্যাগপূর্ণ মুহূর্তগুলো হয়ে যায় সব সন্তানের জন্য এক উদাহরণ, এক অনুপ্রেরণা।

আজ যখন কেউ বলে, ‘সব সন্তান খারাপ’, আমি বলি, না। এখনো কিছু সন্তান আছেন, যারা বাবার জীবনের জন্য নিজের জীবন বাজি রাখেন।

যারা বোঝেন- পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত আশ্রয় হলো বাবার সেই নীরব ভালোবাসার ছায়া।

আজ এই গল্পটি লিখছি এই বিশ্বাস নিয়ে— জীবনের সব কিছুর উৎস যে মানুষটা, তিনি আমাদের বাবা। তাকে ভালোবাসা, তাকে সম্মান করা, তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আর যারা হারিয়ে ফেলেছেন- তারা যেন অন্তত স্মৃতির পাতায় সেই ছায়ার তলে ফিরে যান।

ভালো থাকুন পৃথিবীর সব বাবা। ভালো থাকুক সেই সন্তানরা, যারা এখনো বাবার আশ্রয়কে শ্রেষ্ঠ আশ্রয় বলে মনে করেন।

যে ছায়ায় মানুষ হই, সে ছায়া হারানোর আগেই বারবার বলে ফেলি— “বাবা, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি!”

লেখক : রফিক সরকার, গণমাধ্যমকর্মী

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইলিয়াস কাঞ্চনের মৃত্যুর গুজব, যা বললেন ছেলে জয়

শান্তিতে নোবেলজয়ী মারিয়াকে প্রধান উপদেষ্টার অভিনন্দন

দলে দলে ঘরে ফিরছে হাজারো গাজাবাসী

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

রাজধানী থেকে বগুড়া শহর আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার

হেফাজতে ইসলাম সবার জন্য পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করছে :  এ্যানি

দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

রাবি প্রশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের অভিযোগ

ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কার উৎসর্গ করলেন মারিয়া

দেশের ৪০ শতাংশ নারী থাইরয়েডে আক্রান্ত!

১০

‘এই পচা চালের ভাত কীভাবে খাব’

১১

‘পুলিশ এখন বানরের মতো’ বললেন ওসি হাবিবুল্লাহ

১২

ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে যে একাদশ নিয়ে নামতে পারে আর্জেন্টিনা

১৩

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে একমাত্র পথ সুষ্ঠু নির্বাচন : নীরব

১৪

যশোরের ৪ মহাসড়কে মহাদুর্ভোগ

১৫

সুদের টাকা না পেয়ে ঘরের টিন কাঠ খুঁটি খুলে নিলেন ইমাম

১৬

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের মৃত্যুতে ঢাবি সাদা দলের শোক

১৭

কিউইদের কাছে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শোচনীয় পরাজয়

১৮

বিএনপি আইনের শাসনে বিশ্বাসী : ব্যারিস্টার অসীম

১৯

প্রত্যেক উপদেষ্টা বিদেশি নাগরিক : রুমিন ফারহানা

২০
X