প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১১ পিএম
আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০২:১২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

শিক্ষার ভবিষ্যৎ ও আমাদের অদূরদর্শিতা

প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল। ছবি : সংগৃহীত
প্রফেসর ড. মো. আবদুল জলিল। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতামূলক যুগে একটি জাতির অগ্রগতির প্রধান ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। সঠিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে একটি দেশ তার তরুণ প্রজন্মকে মানবসম্পদে পরিণত করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র আমাদের আশাবাদী করে না।

শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পরিবর্তে আমরা সার্টিফিকেটনির্ভর শিক্ষায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছি, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতির জন্য ক্ষতিকর।

স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বছরের পর বছর ধরে পাঠ্যক্রম নিয়ে কাটাছেঁড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পাসের হার বাড়ানোর কৃত্রিম প্রচেষ্টা শিক্ষাব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা মৌলিক দক্ষতা ও জ্ঞানের ঘাটতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছে। এর ফলে উচ্চ শিক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়ছে এবং হতাশা, অস্থিরতা কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ছে।

শিক্ষকরা পড়ালেখায় প্রয়োজনীয় কঠোরতা না দেখিয়ে শৈথিল্য প্রদর্শন করছেন, ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য—জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বিকাশ—গভীরভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এর পাশাপাশি দেশের উচ্চ শিক্ষা খাতেও দেখা দিয়েছে গুণগত সংকট। প্রায় ২০০টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, গবেষণা বা অবকাঠামো নেই। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সনদ বিতরণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশের জন্য এটি এক ভয়াবহ সংকেত, কারণ শুধু সার্টিফিকেটধারী তরুণের ভিড় আমাদের বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় কোনো কার্যকর অবস্থান তৈরি করতে পারবে না।

এখনকার সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পর্যায়ে আছে। জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ। এ এক বিশাল সম্পদ, তবে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে এটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে, অথচ তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।

উপরন্তু, অনেক গ্র্যাজুয়েটের হাতে যথাযথ কারিগরি জ্ঞান ও ব্যবহারিক দক্ষতা নেই। ফলে দেশে চাকরির সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও কয়েক লাখ বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছে এবং তারা মোটা অঙ্কের বেতন পাচ্ছে। আমাদের তরুণরা যেখানে দক্ষতার অভাবে কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেখানে বিদেশি নাগরিকরা আমাদের অর্থনীতির একটি অংশ সরাসরি নিয়ে যাচ্ছে—এটি নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।

এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে সবচেয়ে যৌক্তিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত হবে—তরুণদেরকে যুগোপযোগী, মানসম্মত ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং যত বেশি সংখ্যক তরুণকে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে পাঠানো। বর্তমানে বাংলাদেশে যে হারে গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে, তাদের জন্য দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানি করা কেবল বেকারত্ব নিরসনের পথ নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অন্যতম মাধ্যম।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার তাই সময়ের দাবি। সার্টিফিকেটনির্ভরতা থেকে বের হয়ে ব্যবহারিক ও প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানচর্চা বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষক, গবেষণা ও অবকাঠামোতে শক্তিশালী করতে হবে। বিদেশি শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষা ও ভাষাগত দক্ষতা অর্জনে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি, তরুণদের নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা শুধু চাকরিজীবী নয়; বরং দায়িত্বশীল বৈশ্বিক নাগরিক হতে পারে।

বাংলাদেশের আগামী ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই বিশাল তরুণ জনসংখ্যাকে কতটা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তার ওপর। যদি আমরা মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হই, তবে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডই একদিন বোঝায় পরিণত হবে। কিন্তু যদি আমরা সময়ের দাবি অনুযায়ী দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে এই তরুণরাই হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং টেকসই উন্নয়নের আসল চালিকাশক্তি।

লেখক- শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক ডিন, ফ্যাকাল্টি অব সায়েন্স এবং ফ্যাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রাশেদের

জুমার দিনে ইসলামি বইমেলায় পাঠকদের ভিড়

ফ্লোটিলা নৌবহরে ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ

মোবাইলে আফগানিস্তান-বাংলাদেশ দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি দেখবেন যেভাবে

১০ দিনের শিশুকে হত্যার পর যে কাণ্ড ঘটালেন মা

সিনেমার কায়দায় মেয়েকে অপহরণ করলেন মা-বাবা

প্রতিমা বিসর্জনের সময় নৌকাডুবি, এক শিশুর লাশ উদ্ধার

ফ্লোটিলা আটকের ঘটনায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলল তুরস্ক

বছরে পাঁচ কোটি আয়, তবু কেন ঝাড়ুদারের কাজ করেন এই ব্যক্তি?

মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে মজিদ মল্লিক ফাউন্ডেশন

১০

ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে খুলনার রাজনীতিতে পারভেজ মল্লিক

১১

শিক্ষার ভবিষ্যৎ ও আমাদের অদূরদর্শিতা

১২

গাজামুখী শেষ নৌযান ম্যারিনেটও আটক

১৩

বাংলাদেশসহ যে ১৭ দলের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত

১৪

জুবিনের শেষ মুহূর্তের ভিডিও করা সহশিল্পী গ্রেপ্তার

১৫

যে কারণে রাজধানীতে বাস থামিয়ে গুলি-আগুন

১৬

‘আজাদ কাশ্মীর’ মন্তব্যে বিতর্ক, মুখ খুললেন সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক

১৭

গুগল ম্যাপের গোপন বৈশিষ্ট্য, যা জানেন না অনেকেই

১৮

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য চমক রেখে জার্মানির দল ঘোষণা

১৯

নদী ইজারা দিল মসজিদ কমিটি

২০
X