ছোটবেলায় বাপ-চাচাদের প্রায়ই পান্তা ভাত খেতে দেখেছি। আমিও খেয়েছি। সেই সময়ে পান্তা ভাত ছিল অধিকাংশ কৃষক-শ্রমিকের সকালের নাস্তা। তবে পান্তা ভাত ইলিশ মাছ নয়, বরং গুড়, চিনি, কলা, ডিমভাজি বা তরি-তরকারি, এমনকি কেবল লবণ-মরিচ দিয়ে খাওয়া হতো।
বৈশাখে সারা দেশে বিভিন্ন এলাকায় বৈশাখী মেলা আয়োজিত হতো, যেখানে জিলাপি, মুড়ি, বাতাসা, মিষ্টি, পিঠা, পায়েসসহ বিভিন্ন খাবার-দাবার বিক্রি হতো। মাটির তৈরি পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, কাগজের ঘুড়ি, বেতের বাঁশি, বিভিন্ন কারুকাজ ও আসবাবপত্র প্রদর্শিত হতো। ছোট বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য চরকির ব্যবস্থা থাকত। বৈশাখ মাসের শুরুতে, ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা তাদের পাওনা আদায়ের জন্য ‘হালখাতা’ আয়োজন করতেন। এসব কার্যক্রম ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে কোনো সংঘাত সৃষ্টি করত না।
কিছু মেলায় নাচ-গানের পাশাপাশি জুয়া খেলার ব্যবস্থা থাকত, ইসলাম যা সমর্থন করে না। এসব কারণে, আলেম সমাজ মুসলমানদের বিশেষ করে তাদের সন্তান-সন্ততিকে মেলায় যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতেন। পরে স্থানীয় আলেমদের প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখে অনেক স্থানে জুয়া খেলা বন্ধ হয়ে যায়।
নব্বইয়ের দশকে রমনা বটমূলে বৈশাখী সংস্কৃতিতে পান্তা ভাতে ইলিশের সংযোজন এবং আনন্দ শোভাযাত্রা পরিবর্তে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ প্রবর্তন ঘটে। যদিও কিছু ইসলামিক স্কলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ও এতে প্রদর্শিত প্রতিমা, হুতোম প্যাঁচায় মুখোশ ব্যবহারের বিরোধিতা করছেন, কারণ তা তাদের মতে মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রশ্ন উঠেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ, হুতোম প্যাঁচায় মুখোশ ধারন, উল্কি আঁকা ইত্যাদি বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত উপাদান কি না! আর ইসলামিক স্কলাররা এসব উপাদানের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতির সংঘাত খুঁজে পান। অনেকেই মনে করেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপন কোনো বিশেষ ধর্মের অনুষ্ঠান নয়। অন্যদিকে এটি কোনো ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া উচিত নয়।
ভারতের পশ্চিমবাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক চর্চা করবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশি বাঙালিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চা- এখন সময়ের দাবি। নচেৎ বৈশাখী আয়োজন কখনোই সার্বজনীন হবে না। আমরা যদি আমাদের ঐতিহ্যগত বৈশাখী সংস্কৃতিতে ফিরে যাই, তাহলে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাংলা বর্ষবরণকে গ্রহণযোগ্য ও আনন্দময় করতে পারব বলে মনে হয়। এদেশের বৈশাখী সংস্কৃতির বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমাদের ঐতিহ্য পান্তা ভাতের সংস্কৃতি, বিশেষ পোশাক পরিধান, মেলার আয়োজন, বর্ষবরণে সংগীতানুষ্ঠান, ব্যবসায়িক হালখাতা ও আতিথেয়তা। তাই নববর্ষ পালিত হোক আমাদের ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চায়, যা সম্প্রীতি ও শান্তি বয়ে আনবে।
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
লেখক ড. ফরিদ আহমদ সোবহানী
প্রফেসর, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিক্সমন্তব্য করুন