ডা. আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর ২৪তম প্রয়াণবার্ষিকী

মমতা ও বাৎসল্যে অতুলনীয় তিনি

kalbela
ছবি: কালবেলা

আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি। সমাজহিতৈষী ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর ২৪তম প্রয়াণবার্ষিকী। ২০০০ সালের এই দিনে তিনি প্রয়াত হন। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মৃতিচারণ করেছেন তার দৌহিত্র ডা. আতাউর রহমান।

১.

‘এ-য়া! ইতারারে ভাত দেন্না? হঁত্তে দিবোদে?’ (অ্যা-ই! এদেরকে কি ভাত দেয়া হচ্ছে? কখন দেয়া হবে?) এর মধ্যেই হয়তো খেলতে খেলতে আমি বা সমবয়সী খালাতো ভাইবোনদের কেউ গিয়ে পড়লাম তার সামনে। সরাসরি প্রশ্ন—‘তোঁয়ার নানী তোঁয়ারারে ভাত দেন্না? ন দিলে হ, তোঁয়ার নানীরে গুলি গরি দি।’ (তোমার নানী কি তোমাদেরকে ভাত দিচ্ছে? না দিলে বলো, তোমার নানীকে গুলি করে দিই!)

বলে কী! শুধু খাবার দিতে দেরি হচ্ছে বলে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে গুলি করে দেবে? এ-ও সম্ভব? অতিশৈশবে আমার কিছু বিস্ময়ের একটি ছিল এটি। বহুদিন পর্যন্ত আমি এক ধরনের চাপা আতঙ্ক নিয়ে ঠিক বিশ্বাস করে এসেছি—নানাভাই সত্যি সত্যি আমার নানীকে গুলি করে দিতে পারে!

চর্মচক্ষে দেখার সৌভাগ্য (কিংবা দুর্ভাগ্য) কখনো হয় নি, কিন্তু আমরা সবাই জানতাম নানাভাইয়ের একটা লাইসেন্সকৃত বন্দুক আছে! এই বন্দুক নিয়ে ফিরোজ নানার* বয়ানে শোনা অতিলৌকিক সব গল্প-ঘটনাগুলো ঠিক সে মুহূর্তে কল্পচোখে ভেসে ওঠে আর আমার শিশুতোষ আশঙ্কা ক্রমশ ঘনীভূত হয়।

চিরভীতু আমার তখন জেরবার অবস্থা, তাই নানাভাইয়ের ওই প্রাণঘাতী রুটিন প্রশ্নটির উত্তরে আমি সর্বোচ্চ সাধ্যে তাকে বিভিন্নভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতাম। নানীর, আমরা ডাকতাম নানাবী, হেঁশেলের কোনো হালনাগাদ তথ্য ছাড়াই নানাভাইকে আমার মতো করে বলতাম—‘দিচ্ছে, এখনই দিয়ে দেবে! রান্না প্রায় শে-ষ!!’

আমরা, মানে তার নাতি-নাতনিরা যখন ঈদের ছুটি বা কোনো উৎসব-অবকাশে বৈলছড়ির নানাবাড়িতে যেতাম, তখন বেলা ১২টা কোনোভাবে বাজত কি শুরু হতো নানাভাইয়ের মুহুর্মুহু হৈ-হুংকার, হাঁকডাক আর লাগাতার হুমকি! বসার ঘরে তার নির্দিষ্ট কাঠের চেয়ারটিতে বসে চড়া কণ্ঠে পুনঃ পুনঃ একই প্রশ্ন—‘এ-য়া! ইতারারে ভাত দেন্না? হঁত্তে দিবোদে?’

এই ছিলেন নানাভাই। মরহুম ফয়েজ আহমদ চৌধুরী। কঠিনে, কোমলে, বাৎসল্যে আর অনন্য আতিথেয়তায় একজন উচ্চকিত মানুষ। একজন নীরব ও দায়িত্বশীল বিদ্যানুরাগী। একজন স্বশিক্ষিত মানুষ।

[*ফিরোজ আহমদ চৌধুরী। আমার নানাবীর জ্ঞাতিভাই। সম্পর্কে আমাদের নানা। রক্তসূত্রে আপন নন সত্যি, কিন্তু মমতাসূত্রে তার চেয়েও শতগুণ আপন। আমাদের মা-খালা-মামারা থেকে শুরু করে আমাদের ভাগ্নে-ভাগ্নিরা এবং মাঝে আমরা-সহ কুল্লে তিন প্রজন্মের শৈশবকে তিনি রঙিন ও আনন্দময় করে রেখেছিলেন তার বিচিত্র কর্মকাণ্ড, স্ব-উদ্ভাবিত (!) সামরিক প্রশিক্ষণ আর অলীক সব গল্পসম্ভার দিয়ে। তাকে ছাড়া অকল্পনীয় ছিল আমাদের শৈশব-কৈশোর। আমাদের শৈশব-স্মৃতিচারণও অসম্পূর্ণ তাকে ছাড়া! সদ্যপ্রয়াত ফিরোজ নানাকে নিয়ে লিখতে গেলে দরকার হবে গোটা একখানা বই।]

২.

ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট। মার্কিন এই বিজনেস টাইকুন নিজের সাদাসিধে জীবনযাপন আর উচ্চায়ত জীবনবোধের জন্যে দুনিয়াজুড়ে বেশ আলোচিত, অনুসরণীয় এবং কারো কারো কাছে প্রায় দার্শনিকের মর্যাদাপ্রাপ্ত। ৯৪ বছরের এই তরুণ (!) মানুষ হিসেবে কেমন, কিংবা তার কাজের ভালো-মন্দ—ওসব অন্য গল্প।

বেশ কবছর আগে তার একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। প্রশ্নকর্ত্রী জানতে চাইলেন—‘এ জীবনে পাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ কোনটা, যা আপনাকে এমন কৃতবিদ্য করে তুলেছে?’

এই গ্রহের সবচেয়ে চৌকস ও সফল বিনিয়োগকারী বলে নন্দিত এ মানুষটি উত্তরে বললেন কোনো অর্থনীতি, টাকাপয়সা, হিসেবপত্তর কিংবা ব্যবসা-সংক্রান্ত কথা নয়; নয় সেটা কোনো উপদেশও, তিনি বললেন একেবারেই বিমূর্ত একটি জিনিসের কথা—‘আনকন্ডিশনাল লাভ্ (Uncondiotional Love)’! এই ‘নিঃশর্ত মমতা’ ওয়ারেন সাহেব পেয়েছেন তার বাবার কাছে। ওটাই তার যাবতীয় সাফল্যের রহস্য!

জানি না কেন, ‘নিঃশর্ত মমতা’ কথাটা প্রথম যেদিন শুনেছি, আজও যতবার শুনি কিংবা মনে হয়, একজনেরই চেহারা ভেসে ওঠে মনের চোখে—‘নানাভাই’। চারপাশের প্রায় প্রতিটি মানুষ ও পরিবারের জন্যে স্বতঃস্ফূর্ত মমতা ধারণ করার বিরল একটা ক্ষমতা নানাভাইয়ের ছিল। নিজের সন্তানদের জন্যে যে মমতা নানাভাইয়ের ছিল, দৃশ্যত প্রায় একই মমতা সমান্তরালে তিনি ধারণ করতেন চারপাশের বহু আত্মীয়-পরিচিত-পরিজন-প্রতিবেশীর সন্তানদের জন্যেও। একাধিক নির্ভরযোগ্য বয়ানে তো শুনেছিই, আমার শৈশবস্মৃতিও সাক্ষ্য দেয় এর সপক্ষে। নানাবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, আমাদের ফার্স্ট কাজিনদের পাশাপাশি কিছুটা দূরবর্তী সম্পর্কের কাজিনরাও সমান আদর-সম্মানে সেই বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে।

একাধিক বিশ্বস্ত ভাষ্যে শুনেছি—যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন সুগম ছিল না ততটা, সে-কালে বোর্ড পরীক্ষা চলাকালে বাঁশখালীর বৈলছড়ি থেকে জলদিস্থ পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়া-আসা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে বলে ফি বছরই নাকি কয়েকজন পরিক্ষার্থীকে নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করতেন নানাভাই। সেবা ও মমতা বিতরণে নিকটাত্মীয় দূরাত্মীয় ভেদ তার ছিল না।

৩.

সেই ৫৫/৬০ বছর আগে, চট্টগ্রাম শহর থেকে বেশ দূরের একটি জনপদ বাঁশখালী। গোটা দেশেই-বা শিক্ষার হার তখন কত? আর মেয়েদের শিক্ষার হার? বৈলছড়িতে, সেই গ্রামে থেকেই নানাভাই তার চার কন্যাকে তখন পড়াশোনা করিয়ে যাচ্ছেন, চারপাশের সব রকম নিরুৎসাহ এমনকি প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে। এমনও শুনেছি, স্থানীয় ওয়াজ মাহফিল থেকে নাকি মাইকে সমালোচনা পর্যন্ত হয়েছে যে, ‘অমুক’ কেন তার মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা করাচ্ছেন! কিন্তু নানাভাই সিদ্ধান্তে অটল। কর্মে অবিচল। তার কন্যাদের পড়াশোনা বন্ধ হবে না।

কতটা অবিচল, বুঝতে পারি আমার মায়ের কাছে শোনা একটি ঘটনায়। ক্লাস এইট পেরিয়ে আমার মা উঠলেন ক্লাস নাইনে। কিন্তু স্থানীয় স্কুলটি তখনও বিজ্ঞান বিভাগ শুরু করার অনুমোদন পায় নি। কিন্তু কনিষ্ঠা কন্যাকে যে নানাভাইয়ের সায়েন্স নিয়ে পড়ানোর ইচ্ছা! তাহলে উপায়? শিক্ষা বিভাগের পদস্থ একে-তাকে ধরে সে বছরই স্কুলে সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট চালুর ব্যবস্থা করলেন নানাভাই!

প্রায় কাছাকাছি রকম আরেকটা কাণ্ড নাকি নানাভাই করেছিলেন আমার মেজ খালাকে (হোসনে আরা বেগম, জলদি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা) নিয়ে। বাঁশখালী কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নেই তাকে ওখানে ভর্তি করে দিয়েছিলেন এবং নিশ্চিত করেছিলেন যেন তার রোল নম্বর হয় ১ (এক)। সেই সূত্রে তিনি ওই কলেজের প্রথম ছাত্রী। (কলেজটির ইতিহাস রচনা করবেন যে ভবিষ্যৎ-গবেষক, তার কাছে এই তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ হবে নিশ্চয়ই।)

আমরা তখন চট্টগ্রামের সেন্ট মেরী’স স্কুলে পড়ি। সন্ধ্যায় আমি আর ছোট ভাই সুজাত মায়ের কাছে প্রতিদিন পড়তে বসি (নিতান্ত অনিচ্ছায়!)। আমরা যখন পড়তাম চেয়ার-টেবিলে বসে, পেছনে খাটে আধশোয়া নানাভাই চুপচাপ দেখতেন আমাদের পড়াশোনা। একদিন নাকি নীরবে আমার মেজমামাকে ডেকে আর্দ্রকণ্ঠে বললেন, ‘দেখেছ! আমি যে আমার মেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছি, আজ আমার মেয়ে কী সুন্দর তার বাচ্চাদের পড়াচ্ছে!’ কিন্তু তিনি ছিলেন একজন ‘নিভৃতচারী’ শিক্ষানুরাগী। নিভৃতচারী ব্যাপারটা কেমন?

নানাভাই যে বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা (১৯৬৭), আশ্চর্য হলেও সত্যি, কথাটা কোনোদিন আমি তার মুখে শুনি নি! এ নিয়ে কোনো বলা-কওয়া, উচ্চবাচ্চ্য কিংবা স্বীকৃতি দাবি তো দূরস্য দূরের কথা, নিছক তথ্য হিসেবেও আত্মবয়ানে তিনি কোনোদিন এটি আমাদের কাছে সরবরাহ করেন নি। অন্তত আমি শুনি নি, আমার সামনে কাউকে বলেছেন, তা-ও দেখি নি।

কৈশোরে আমার অন্যতম বিনোদন ছিল আমার বাবার স্টাডিতে বসে সকৌতূহলে নানান প্রকৃতি ও আকৃতির বইপত্র উল্টেপাল্টে দেখা। বুকশেলফের কোণ-ঘুপচি, অলি-গলি, তস্যগলিতে কোথায় কোন বই লুকিয়ে-ঘুমিয়ে আছে আর তার ভেতরে কী আছে, সেই রহস্য ভেদ করা আমার কাছে গুপ্তধন খুঁজে বেড়ানোর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর ছিল না! এভাবেই একদিন হাতে পেয়ে যাই গত শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওহীদুল আলমের (১৯১১-১৯৯৮) লেখা একটি বই—‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’।

১৯৮২ সালে প্রকাশিত বইটি এখন লভ্য কিনা জানি না, সেটি নাড়াচাড়া করতে গিয়েই আবিষ্কার করেছিলাম এই দুর্লভ তথ্য। যতদূর মনে করতে পারি, বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চারজনের নাম উল্লেখ করেছিলেন কবি ওহীদুল আলম, তার মধ্যে তৃতীয় কি চতুর্থ নামটি ছিল ‘বৈলছড়ি নিবাসী ফয়েজ আহমদ চৌধুরী’।

বাঁশখালী ডিগ্রী কলেজের অতীত কিংবা বর্তমান পড়ুয়াদের কথা বাদই দিলাম, আমি প্রায় নিশ্চিত—এই তথ্য আমাদের স্বজন-পরিজনদেরই অনেকের অজানা, এমনকি আমাদের কাছের-দূরের অনেক কাজিনদেরও! প্রসঙ্গটা মনে হলে শত বৎসরকাল আগে ‘জোড়াসাঁকোর জ্ঞানী বুড়ো’র লেখা একটা অমর কবিতার কয়েকটা কথা আমার চোখে ভাসে—নিজেরে করিতে গৌরবদান/ নিজেরে কেবলি করি অপমান/... আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে,/ তোমারি ইচ্ছা করো হে পূর্ণ আমার জীবনমাঝে।’

৪.

২০০২ সালের কোনো একদিন:

সেদিন রাতে ইউএসটিসি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে গেছি। সহপাঠীদের কেউ একজন বোধহয় অসুস্থ বোধ করছিল। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে আইভি স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আমরা তিন-চারজন বন্ধু বসে আছি কর্তব্যরত চিকিৎসকের ডেস্কের সামনে।

কথায় কথায় ডাক্তার সাহেব জানলেন আমার বাড়ি বাঁশখালী। আত্মীয়তার নানান সুতো ধরে এদিক-ওদিক টানাটানি করে সবিস্তারে আমার বংশ-ঠিকুজি উদ্ঘাটন করে ফেললেন ভদ্রলোক (চাঁটগাইয়াদের এই এক গগণিবদারী প্রতিভা!)। অতঃপর খোলাসা করলেন নিজের পরিচয়—তার বাড়িও বাঁশখালী এবং ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর তিনি দূরাত্মীয় নাতি!

এরপর নানাভাইয়ের সাথে তাদের বহু পারিবারিক স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। একপর্যায়ে বললেন, ‘নানাকে আমরা বেশ ভয়ই পেতাম একসময়!’

কেন? এত প্রকার সুখস্মৃতি যাকে ঘিরে, তাকে আবার ভয় কেন?

ইতস্তত হাসিতে বললেন তিনি—‘ডাক্তারি পাশ করে বেরোনোর পর, সেই তরুণ বয়সে নানা আমাদের বাড়ি এলে কিংবা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা পারতপক্ষে তার সামনে পড়তাম না। কারণ আশেপাশে বিবাহযোগ্য কোনো ছেলে বা মেয়ে দেখলে দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলতেন! আর ওনার প্রস্তাবটাই ছিল এক ধরনের আদেশ।’

মা-খালাদের মুখে শুনেছি, কখনো-বা এমন বিয়ের সিদ্ধান্ত নানাভাই দিয়েছেন তৎক্ষণাৎ! হয়তো ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠানে কি সামাজিক আলাপে ছেলের বাবাকে ডেকে বলেছেন, ‘শোনো! অমুকের একটা মেয়ে আছে, জানো তো। মেয়েটা ভালো। আসছে অমুক তারিখ, দিনটা শুক্রবার আছে, একটা নতুন শাড়ি আর তোমাদের কাছের কিছু আত্মীয়স্বজন নিয়ে চলে যেও ওদের বাড়ি। আমি থাকব ওখানে। বিয়ে পড়ানো হবে।’

আদেশ শিরোধার্য, বলাই বাহুল্য:

আমি ভাবি—কেবল ব্যক্তিত্ব নয়, সাহসও লাগে! পুঁজিবাদের বিশ্বায়নে সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান-আয়োজনগুলো যখন দৃষ্টিকটু জৌলুস আর নতুন টাকার উদ্ভট প্রদর্শনীতে রূপ নিয়েছে, তখন প্রতিটা বৃহত্তর পরিবারে এ ধরনের দু-চারজন মানুষ খুব দরকার ছিল। ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ বলে যে উত্তরাধুনিক আপদটি হালে করোনার চেয়েও বেহাল গতিতে সংক্রমিত হচ্ছে, তার অন্তত কিছু প্রতিকার বোধহয় করা যেত!

৫.

মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাই বিভিন্নভাবে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়, অনাত্মীয়দের প্রয়োজনে এগিয়ে গেছেন। নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করেছেন একাধিক পরিবারকে।

সে-সময়ের একটা ঘটনা শুনেছিলাম আমার মায়ের কাছে। ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ, কিন্তু গভীরে তাকালে তাৎপর্য ব্যাপক।

একজন যশস্বী চিকিৎসক। হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধকালে অন্যত্র থাকলেও, চিকিৎসকের একমাত্র তরুণ পুত্রটি তখন নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করছিল আমার নানাবাড়ির অনতিদূরস্থ কোনো একটি মুসলমান পরিবারে। আশ্রয়দাতা পরিবারের কর্তাও একজন চিকিৎসক। দুই পরিবারই সামাজিকভাবে নানাভাইয়ের পরিচিত।

বিপ্লবের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য...’ কবিতাটি নয়, সেই হিন্দু চিকিৎসকপুত্রের প্রিয় কবিতা বোধকরি ছিল একই হাতে রচিত ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত’। অতএব, যা হওয়ার তা-ই হলো। তরুণটি প্রণয়ে জড়িয়ে গেল আশ্রয়দাতা পরিবারের কন্যাটির সাথে। আশ্রয়দাতা পরিবারের সম্মতিতে দুজনের সম্পর্কটি বিয়ে অবধি গড়াতে যাচ্ছে। ছেলেটিও ধর্মান্তরিত হতে খুব সম্মত! নানাভাই ঘটনা শুনলেন। আমি ভাবি, নানাভাইয়ের জায়গায় আমি হলে কী করতাম? নিজেকে ঠিক তার জায়গায় দাঁড় করাই। ঘটনার সময়কাল, প্রেক্ষাপট, পটভূমি বিবেচনা করি। অর্ধশতাব্দীকাল আগের বাংলাদেশ, দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি গ্রাম, উপরন্তু যুদ্ধের মতো অশান্ত পরিস্থিতি, এর চেয়ে বড় কথা—হিন্দু ধর্মের একজন লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যুদ্ধের সময় তো চারিদিকে অনেক হিন্দুরাই বাধ্য হয়ে মুসলমান হচ্ছে! অতএব সমস্যা কী? নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ্ এন্ড ওয়ার। একে লাভ্, তার ওপর ওয়ার—আপত্তি অনাবশ্যক।

একান্তে এই ভয়টাও কি একটু পেতাম না যে, একজন লোক হিন্দু থেকে মুসলমান হতে চাচ্ছে, তাতে বাগড়া দিয়ে কী পাপই না আবার করে ফেলি! কতিপয় স্বধর্মাবলম্বীর চোখে পাপিষ্ঠই না সাব্যস্ত হয়ে যাই! এই ভয়টা যদি না-ও পেতাম, তবু আসন্ন বিয়েটাতে কোনো বাধা মনে হয় আমি দিতাম না। আমার মতামত বা সিদ্ধান্ত কেউ চাইলে শতভাগ সম্মত না হলেও বড়জোর মৃদু মিন‌মিন করতাম, নয়তো চুপ থাকতাম।

নানাভাই করলেন উল্টোটা।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দূর অস্ত, আশৈশব জীবনের বহুতর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডিটাও যিনি পেরোতে পারেন নি, আনুষ্ঠানিকভাবে যিনি কোনোদিন কোনো প্রগতিবাদে দীক্ষা নেন নি, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা’ শব্দটি তার জানা ছিল কিনা তা-ও জানি না, কোনো বিশেষ পন্থী ছিলেন বলেও শুনি নি কখনো—সেই লোকটিই, যিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ঘটনা জানা মাত্রই খবর দিলেন ছেলের মা-বাবাকে—‘তোমাদের ছেলে ধর্মান্তরিত হয়ে ভিন্ন ধর্মের একটি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে! অনতিবিলম্বে এসে বা যেভাবে পারো তোমরা ওকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো!’

নানাভাইয়ের যুক্তিটা ছিল—‘এই ছেলে তার পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান! কেন সে ধর্মান্তরিত হবে? ধর্ম বদলে পরিবারছিন্ন হলে ওর মা-বাবার কী হবে তখন? সন্তান হারিয়ে ওরা যাবেন কোথায়?’। ধর্মান্ধতা, সব রকম ভয় ও যাবতীয় সংস্কারের পরিধি ছাপিয়ে এই ঘটনাটিকে তিনি দেখেছিলেন তার সহজাত মানবিকতা, বাস্তববুদ্ধি আর গভীর বিবেচনাবোধের জায়গা থেকে। করণীয় নির্ধারণে তাই বিলম্ব হয় নি তার।

সংসারে কিছু মানুষ নিশ্চয়ই সব কালেই ছিল, যাদের নামের গোড়ায় বিশেষণ হিসেবে যুক্ত হতে পারলে ‘অসাম্প্রদায়িক’ শব্দটিই বরং এক ধরনের শ্লাঘা অনুভব করে!

৬.

নানাভাইকে আমি যতদিন পেয়েছি—দেখেছি তিনি আপাদমস্তক বাৎসল্যরসে সিক্ত একজন মানুষ। আমার মা-খালা-মামাদের নাম ধরে ডাকতে আমি তাকে দেখেছি খুব কমই। সন্তানদের প্রতি তার বরাবরের সম্বোধন ছিল—‘অ-ফুত’, ‘অ-ঝি’। অনুবাদ করে না দিলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না সার্বজনীন এই মমতাভাষা।

আর আমাদের, মানে নাতি-নাতনিদের প্রতি তার বাৎসল্যও ছিল অতিরিক্ত রকমের। ‘অতিরিক্ত’ শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম! কেন বলছি।

অনেক বছর আগে শোনা। ধারণা করি, আমি তখন বেশ ছোট, কারণ ঘটনা মনে করতে পারি না।

ফিরোজ নানা একদিন আমাদের চট্টগ্রাম শহরের বাসা থেকে সকালে রওনা করে দুপুরে নানাবাড়ি বৈলছড়ি গিয়ে পৌঁছেছেন। আগের দিন কোনো একটা কারণে আমার বাবার হাতে আমার কিছু উত্তম-মধ্যম জুটেছিল। সে যুগে এমন মৃদু থেকে শুরু করে মাঝারি এমনকি ভারী উত্তম-মধ্যম ছিল ঘরে ঘরে নিতান্ত সাধারণ ঘটনা। বরং তেমন কিছু না হওয়াটাই কতকটা যেন ছিল অস্বাভাবিক। যা-হোক, নানাবাড়ি গিয়ে কথায় কথায় ফিরোজ নানা আমার নানাবীকে কিছুটা খেদের সঙ্গেই বোধহয় কথাটা বলছিলেন*। নানাভাই তখন খাচ্ছিলেন। তিনি শুনলেন কথাটা। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করেই তৎক্ষণাৎ নাকি তিনি বাসে চড়ে রওনা করেন চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে। সরাসরি চলে আসেন আমাদের বাসায়। আমার মা-কে তার প্রথম জিজ্ঞাসা—‘আমরা কি তোমাদের মেরেছি কখনো? তাহলে তোমরা কেন বাচ্চাদের মারছ?’

আজকাল মাঝেমধ্যে ভাবি, আচ্ছা, ওই চার-পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পথ বাসে বসে নানাভাই কী ভাবছিলেন? যুগপৎ রোষ ও বেদনার অনুভূতিটা কেমন ছিল তার সেদিন?

যে কালে প্রায় শতভাগ পরিবারেই ‘স্পেয়ার দ্য রড, স্পয়েল দ্য চাইল্ড’ ছিল আদর্শ প্যারেন্টিং নীতি, এমনকি সন্তান মানুষ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ও কৌশল—নানাভাই হেঁটেছেন তখন স্রোতের বিপরীতে।

[*আমাদের বৃহত্তর পরিবারের যাবতীয় খবর, অখবর, না-খবর সব ফিরোজ নানার ট্যাঁকে গোঁজা থাকত অনিবার্যভাবে। আত্মীয়স্বজন কোথায় কার কী অবস্থা, আমাদের জানা হতো তার মাধ্যমেই। সবার হালহকিকত বিষয়ে সাম্প্রতিকতম তথ্যের তিনি ছিলেন নিশ্চিত ও প্রধান উৎস। খালাতো ভাই ইমু মজা করে নাম দিয়েছিল ‘দৈনিক ফিরোজ’!]।

৭.

নানাভাইয়ের অহিংস প্যারেন্টিং দর্শন নিয়ে বলছিলাম। পিতা হিসেবে তিনি কি সফল? তার সন্তানদের কেউই দুর্ধর্ষ শিল্পপতি, মারকুটে আমলা কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির সিইও বা নিদেনপক্ষে একজন তুখোড় এক্সিকিউটিভ হতে পারেন নি! তাহলে?

কিন্তু আমার দেখা বহু মান্যজনের চাইতে নানাভাই অনেক বেশি সফল একজন পিতা। তার সন্তানদের সবাই সমাজের জন্যে নিরাপদ, পারিপার্শ্বিক মানুষগুলোর জন্যে নিরাপদ, বৃহত্তর পরিবারভুক্ত সবার জন্যে নিরাপদ। স্ব স্ব পরিমণ্ডলে প্রত্যেকেই তারা সম্মানিত, আদৃত। এই মাপকাঠিতে আট সন্তানের পিতা হিসেবে তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। কারণ এমন পরিবার আমি একাধিক দেখেছি, ভাইবোনদের কেউ একজন দশের চোখে মান্যবর তো দেখা গেল আরেকজন আক্ষরিক অর্থেই দুর্জন।

অতএব, দুর্বৃত্তপীড়িত একটা সমাজে সন্তানদের সব কজনকে সহৃদয়, নির্বিবাদী, নির্লোভ এবং সকলের তরে নিরাপদ করে রেখে যেতে পারাটা নিঃসন্দেহে একটা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

৮.

প্রসঙ্গত বলতে হয় নানাবীর কথা। তা না হলে আমার নানাভাই মানুষটার চিত্রায়ণ সম্পূর্ণ হয় না।

সর্বার্থেই একজন মহাপ্রাণ মানুষ ছিলেন আমার নানাবী। রান্নাঘর ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্তর্পণ আনাগোনো ছাড়া তাকে সারাটা দিন আর কোথাও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হতো অদৃশ্যে তিনিই বাড়িটার প্রাণ—একটা কোষের নিউক্লিয়াস যেমন। এ বাড়ির প্রধান যে বৈশিষ্ট্য, এর অবারিত আতিথেয়তা আর অক্লান্ত আপ্যায়ন, সেই মঞ্চের দৃশ্যমান চরিত্র হিসেবে সবসময় নানাভাইকে মূল ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে সত্যি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আবর্তিত হচ্ছে যাকে ঘিরে আর সুসম্পাদিত হয়ে উঠছে যার দশভূজাবৎ নৈপুণ্যে—তিনি আমার নানাবী।

নাতি-নাতনিদের কারো ইচ্ছে হয়েছে নারকেলের বরফি খাবে, নানাবীর কানে গেছে কথাটা, সন্ধ্যার চা পর্ব শেষে তিনি বসে গেছেন হেঁশেল-সহকারীদের নিয়ে। দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা কাজ, কিন্তু তিনি ক্লান্তিহীন। কেউ হয়তো তেমন কিছু না ভেবেই বলে বসেছে, কাল সকালের নাশতায় মুচমুচে ভাপা পিঠা (ওই বাড়ির অতি জনপ্রিয় ও উপাদেয় পদ। না খেয়েছেন বা না দেখেছেন যিনি—তাকে এর মহিমা বোঝানো দুঃসাধ্য নয় কেবল, অসম্ভব!) হলে খুব ভালো হতো! পরদিন সকালে নাশতার সময় দেখা গেল টেবিলফুঁড়ে সেই জিনিস হাজির! সবাই হৈ-হুল্লোড় করে খাচ্ছে। ঠিক তখনই নানাবীকে রান্নাঘরে না পেয়ে কেউ একজন খুঁজতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করলেন নিজের চৌকিতে। শরীরটা খারাপ লাগছে তার, মাথা চক্কর দিচ্ছে। কেন কেন? ঘটনা জানা গেল খানিক পরেই। রাতের খাবারের পর সবাইকে ঘুমে রেখে এমনকি সহকারীদেরও কাউকে কিছু না জানিয়ে নানাবী একাই বসে পড়েছিলেন চুলোর পাশে। সারাটা রাত ধরে মাটির চুলোয় সেঁকা সেই কুড়মুড়ে ভাপা পিঠাই অতঃপর নাশতার টেবিলে।

কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ তার বেশিক্ষণ ছিল না। কিংবা নিজেই নিতেন না সেই অবসরটুকু। ওই রাতজাগা ক্লান্তি কোনোমতে একটা ডাব খেয়ে পুষিয়ে নিয়ে পুনরায় তিনি ছুটলেন রান্নাঘরের দিকে। দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে হবে তো!

ঘটনাগুলো সব আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত।

এছাড়াও আত্মীয়স্বজন পরিজন-সহ কত বিচিত্র প্রকারের লোকজন যে আসছে, খাচ্ছে, থাকছে বাড়িটায়, দিনে কি রাতে, অতিথি-সৎকারে কোথাও কোনো ত্রুটি হচ্ছে না। অতিথির বয়স কিংবা পেশা-পরিচয় সে বাড়িতে অবিবেচ্য। দাদাবাড়িতে আমাদের প্রতিবেশী এবং পেশাগত পরিচয়ে স্থানীয় স্কুলের দাপ্তরিক কর্মচারী, মফিজ কাকা, একদিন বলছিলেন—‘কিছু একটা পৌঁছে দিতে বা কখনো চলতিপথে তোমার নানাবাড়িতে যে-কবারই গেছি, তোমার নানাভাই কখনো আমাকে ভাত না খাইয়ে ছাড়েন নি!’ অনেক তাবড় আর গণ্য ব্যক্তির চোস্ত মূল্যায়নে একজন মানুষকে যতখানি চেনা যায়, তার চেয়ে ঢের ভালো ও স্পষ্ট ধারণা বোধকরি উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি সম্বন্ধে পাওয়া যায় একজন ‘নগণ্য’ মানুষের সাধারণ কথায়।

নানাভাই ছিলেন দারুণ সামাজিক মানুষ। সবার সাথে চলা, সবাইকে নিয়ে খাওয়া, ব্যাপক আয়োজনে আতিথেয়তা ছিল তার সহজাত চারিত্রবৈশিষ্ট্য। ডাইনিং টেবিলে একত্রে অত লোকের সংকুলান হবে না, তাই মেলাখোলা সুপরিসর বসার ঘরের মেঝেতে একে একে অনেকগুলো পাটি পাতা হয়েছে আর তাতে মুখোমখি দুই সারিতে জনা বিশেক লোক নিয়ে নানাভাই খেতে বসেছেন—সেখানে পরিবারের সদস্য আর আত্মীয় আছেন যেমন, বাইরের অনাত্মীয় লোকও আছেন—এটি সে বাড়ির অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। (এই পরম্পরা সে বাড়িতে আজও বহমান। মামা-মামীদের দৌলতে সেই ঐতিহ্য এখনো সুরক্ষিত।)

নানাভাইয়ের এই সব কাজেকর্মে বরাবরই নেপথ্য থেকে জ্বালানি জুগিয়ে গেছেন আমার নানাবী। জানি না তার ঐকান্তিক সহযোগ ব্যতিরেকে নানাভাইয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা সার্বক্ষণিক লোকহিতৈষা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে যথা অর্থেই তিনি ছিলেন নানাভাইয়ের ‘পূর্ণাঙ্গিণী’।

নানাভাই আর নানাবী, এই দুজনের অনিঃশেষ বাৎসল্যে-আদরে-আপ্যায়নে এবং এ বাড়ির বিচিত্র সব লোকজনের* কিম্ভূত কর্মকাণ্ডে বাড়িটা আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল বাস্তবিকই একটা স্বর্গপুরী। নিখাদ আনন্দ আর অবাধ স্বাধীনতার জায়গা।

[*এই লোকজনগুলো হলো এ বাড়ির একদঙ্গল গৃহকর্মী। সবসময় দেখতাম হালি দুয়েক বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এ বাড়ির অন্দর-বাহির আর চৌহদ্দিজুড়ে বিক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা করছে, এরা যে কে কী কাজ করছে কিংবা আদৌ কিছু করছে কিনা তা-ও বুঝতাম না। এদের কে যে স্থায়ী আর কে যে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত, অথবা আদতেই কেউ নিয়োগ করেছে কিনা এদের, নাকি এমনিই আসে আর যায়, সেটাও কোনোদিন বুঝে উঠতে পারি নি। মালিক আর কর্তাদের তুলনায় এই বাড়ির গৃহকর্মীদের হম্বিতম্বি চোটপাট দেখেছি সবসময় এক কাঠি ওপরে। সে কী দাপুটে হাঁটাচলা আর দেহভঙ্গি একেকজনের! প্রত্যেকে যেন একেকটা স্বাধীন রাষ্ট্র—স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেয়াটা শুধু বাকি! চীন, রাশিয়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিল কি দিল না, তাতে কী এমন আসে যায়!! আর কী যে সব নাম একেকজনের—ফাতোলি, ছা-তের বুড়ি, এজারু, রোশো, ব-দো, মইন্যা … (মোক্ষম উচ্চারণ আর ধ্বনিগত বৈচিত্র্যগুলো লিখে একটুও বোঝানো গেল না। জগতের কোনো ভাষাতেই সম্ভব নয়!)। আরেকজনের নাম ছিল জামাই—কাকে বিয়ে করে যে নিজের নাম হারানোর মতো দুর্গতি হয়েছিল বেচারার, আজও জানি না!

এই সব দেখেশুনে আমার কেবলই মনে হতো—এ বাড়ির বিভিন্ন রুমে রুমে গিয়ে গোপনে সবার কথাবার্তা, হাসি, আলাপগুলো যদি শ্যুট করে নেয়া যেত, তবে ফুটেজ সব একের পর এক জুড়ে দিয়ে নিশ্চিতই বানিয়ে ফেলা যেত সপরিবারে দেখার মতো নির্বাক কি সবাক একটা কমেডি ফিল্ম! একেবারে ‘জীবন থেকে নেয়া’।]

৯.

নানাভাই নিজে বিস্তর আপ্যায়ন-আতিথেয়তা করতেন ঠিক, কিন্তু নিজে তিনি ছিলেন স্বল্পাহারী। আর নিয়মনিষ্ঠ। তার সামগ্রিক জীবনাচারে পরিমিতি আর ‍রুটিন অনুসরণের একটা ব্যাপার ছিল আমি এখনও মনে করতে পারি। আটপৌরে সাধারণ পোশাকেই দেখা গেছে তাকে চিরকাল। নিতান্তই অনাড়ম্বর ছিল তার বেশভূষা। বার্ধক্যজনিত অসুখ-বিসুখ নিয়ে কিছুটা অনুযোগ তিনি প্রায় সময়ই করতেন*। আমাদের বাসায় এলে আমার মা-কে বলতেন—অ-ঝি, আঁই তো আর বেশিদিন ন-বাইচ্যুম (আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না)! তবে কি নানাভাই ছিলেন একজন মুমূর্ষাগ্রস্ত মানুষ?

না।, ওটা ছিল নিছক তার মুখের কথা। এক ধরনের স্বগতোক্তি। ভেতরের কথা নয়। তার সমগ্র অস্তিত্ব ছিল জীবনের দিকে। কারণ মৃত্যুকাঙ্ক্ষী মানুষ কখনো ভোরে জাগতে পারে না, এমনকি অভ্যাসবশতও নয়—যেমনটা পারে না একজন বিষণ্ন মানুষ। নানাভাই কাকডাকা ভোরে জাগতেন।

বৈলছড়িতে দেখেছি আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই তিনি পাশের গ্রাম কালীপুরে তার আম-কাঁঠালের বাগান দেখভাল করে মাইল কয়েক হেঁটে এসেছেন। চট্টগ্রামে থাকলে দেখেছি আমাদের বা মামা-খালাদের যার বাসাতেই উঠেছেন, ওখান থেকে ইতোমধ্যে কারো বাসায় গিয়ে কাজের কথা একপ্রস্থ সেরে ফিরেছেন। একদিন দুদিন নয়, বরং সারা বছর এ-ই ছিল তার নিত্যসূচি। [*জানতে পারলে ভালো হতো—বেঁচে থাকলে এই জাতীয় অনুযোগ নানাভাই এখন করতেন কিনা! খুব একটা সুবিধা মনে হয় করতে পারতেন না। কিংবা ভয়েই হয়তো কিছু বলতেন না! কারণ পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনি, নাত-বৌ মিলিয়ে তার পরিবারেই দেখি চিকিৎসক সংখ্যা বর্তমানে আট। অতএব, শরীর নিয়ে একটা কোনো কাতরতা কি অভিযোগ শোনা মাত্রই দু্ই হালি ডাক্তার যে তার দু-পাশে সটান দাঁড়িয়ে পড়বে—তাতে বিচিত্র কী!]

১০.

অনিত্য জীবন! এই নশ্বর জীবনের কত কিছু যে মিলিয়ে যায় কালের ধূলায়। সময় যে কোনটা রাখবে, কেন রাখবে আর কোনটা রাখবে না, কেনই বা রাখবে না—সে উত্তর বস্তুত কারোই জানা নেই।

নানাভাইয়ের জীবনটা কি রাখা যাবে? মানে, তার জীবনের ইতিহাসটা? জানি না!

কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয়—শৈশবে নিজের মা-বাবাকে হারিয়ে নিঃস্ব একটা মানুষ সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়, উদ্যমে, শ্রমে এবং সবচেয়ে বড় কথা সততায় নিজেকে একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত করলেন, বিস্তৃত সামাজিকতা ও সেবায় সমাজের সব রকম মানুষের সাথে নিজেকে কানেক্ট করলেন, বহু মানুষের দেখভাল করলেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে, সে-সবের সবিস্তার বিবরণ না হোক অন্তত একটা সংক্ষিপ্ত ভাষ্য কি তৈরি করে রাখা যায় না? কিংবা তাকে নিয়ে একটা স্মৃতি-সংকলন? যদিও পরিবারের ভেতরে কি বাইরে তাকে নিয়ে বলতে পারতেন এমন লোকদের চৌদ্দ আনাই বর্তমানে স্বর্গত।

তারপরও উদ্যোগটা নেয়া সঙ্গত। নিজের শেকড়ের গভীরতা জানে যে বৃক্ষ, ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠার জন্যে সে ঠিকই পায় নয়তো জোগাড় করে নিতে পারে একটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস।

হিসেব করে দেখি, নানাভাইয়ের নাতি-নাতনি সংখ্যা এখন সাতাশ। রীতিমতো চাঁদের হাট। উদ্যোগটা কেউ একজন নিতেই পারে।

(আমার লেখাটা আমি সবার আগে দিয়ে রাখলাম!)

১১.

পশ্চিম পুকুরপারে নানাভাইকে সমাধিস্থ করা হচ্ছে—দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে ভাসে। স্পষ্ট। সবাই তার জন্যে নির্দিষ্ট কবরের চারপাশে দাঁড়িয়ে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা আর কর্তব্যকর্মে ব্যস্ত। আমি পেছনে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি সব। একা।

নানাভাইকে কবরে শোয়ানো হলো। কবর ঢেকে দেয়া হলো বাঁশ, গাছালি, মাটি দিয়ে। এবার সমবেত দোয়ার পালা। হাত তুললেন সবাই। অকস্মাৎ এক পশলা বৃষ্টি এসে আলতো করে ভিজিয়ে দিয়ে গেল সবাইকে! রহমতের বৃষ্টি। মিনিট দুই-তিনেক বড়জোর। তারপর ঝিরঝিরে একটা মিষ্টি হাওয়া।

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বৃষ্টি! কদাচিৎ ঘটে। কিন্তু স্রষ্টা যদি তাঁর এক পূণ্যাত্মাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে চান যথোপযুক্ত সমাদরে-সম্মানে আর উপস্থিত সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চান ব্যাপারটা, এমন ‘অস্বাভাবিক’ কত কিছু্ই তো তখন ঘটে। সে-সবের কতটাই বা আর আমাদের জানা!

১২.

সব মিলিয়ে নানাভাই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। সচরাচর আমাদের চেনা যে ছক, তার বাইরের মানুষ। চলেও গেলেন তেমনই ব্যতিক্রমী একটা দিনে। ২৯ ফেব্রুয়ারি। চার বছরে একবারই আসে দিনটা।

আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি। নানাভাইয়ের ২৪তম প্রয়াণ দিবস। ঠিক দুই যুগ পূর্ণ হলো তার বিদায়ের। ২০০০ সালের এই দিনে অনন্তলোকে পাড়ি জমান তিনি। তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই—/ কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।

এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। যেখানেই আছেন করুণাময়ের সান্নিধ্যে নিশ্চয়ই নানাভাই ভালো আছেন তার অগণ্য শুভার্থী আর সেবাপ্রার্থীদের দোয়া ও শুভকামনায়।

ডা. আতাউর রহমান: মেডিকেল কাউন্সিলর এন্ড মোটিভিয়ার, স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

(ভাষা ও বানানরীতি লেখকের নিজস্ব)

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মার্কিন হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে : ট্রাম্প

ইরানের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে যারা

ডিম সেদ্ধ না ভাজা, কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর?

আর্জেন্টাইন বিস্ময়বালকের দুর্দান্ত ফ্রি-কিকে আল-আইনের বিপক্ষে সিটির বিশাল জয়

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘ফিডিং কর্মসূচি’ শিগগিরই শুরু

বার্সা নামেই ক্ষোভ, বিলবাওয়ে মুছে ফেলা হলো নিকোর মুখ

ট্রাম্পকে থামাতে নোবেল দেওয়া হোক : হনসল মেহতা

ইরানের হামলায় ইসরায়েলের হার্মেস-৯০০ ড্রোন ভূপাতিত

১০ জন নিয়েও ক্লাব বিশ্বকাপে রিয়ালের দারুণ জয়

ঝড়বৃষ্টিতে এসি চালানো কি নিরাপদ? হতে পারে যেসব বিপদ

১০

ইরানে মার্কিন হামলার পর মুখ খুললেন খামেনি

১১

সরকারি খাল ভরাট করে বাইপাস সড়ক

১২

সবসময় নিয়ম মেনে কর দিয়ে এসেছি: নুসরাত ইমরোজ তিশা

১৩

পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ কী, যেসব খাবার শুক্রাণু বাড়ায়

১৪

ইসরায়েলে বহুপাল্লার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানের হামলা

১৫

প্রেমের ফাঁদে পড়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খোয়ালেন প্রবাসী

১৬

ঢাকা থেকে সাবেক এমপি তুহিন গ্রেপ্তার

১৭

মার্কিন হামলার পর দ্রুত বাড়ল তেলের দাম, আরও বাড়বে!

১৮

অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, নিহত ৩

১৯

ইরানে মার্কিন হামলার পর কী ঘটছে এখন?

২০
X