বছর খানেক আগে মিরপুরে জলাবদ্ধতার মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের কয়েকজনের মর্মান্তিক মৃত্যু পুরো দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা এখন আর ধনী-গরিব, পায়ে হাঁটা-গাড়ি চড়া বা অভিজাত-অবহেলিত এলাকার ভেদাভেদ মানে না- এটি সর্বগ্রাসী। একসময় শুধু বর্ষাকালেই এ দুর্ভোগ সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন শীত বাদে প্রায় সারা বছরই ঢাকায় জলাবদ্ধতার চিত্র দেখা যায়।
জলাবদ্ধতার পেছনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, নগরজুড়ে কংক্রিটের আবরণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ভুল নীতি ও নিম্নমানের ড্রেনেজ ব্যবস্থার ভূমিকা রয়েছে। ঢাকার ৫,০০০ টন দৈনিক আবর্জনার মাত্র ৫০% অপসারণ হয়, বাকিটা ড্রেনেজে জমে পানি প্রবাহ বন্ধ করে। ৭০% এলাকাও কংক্রিটে ঢাকা, ফলে মাটির স্বাভাবিক পানি শোষণ ক্ষমতা আগের তুলনায় কমে গেছে প্রায় ৮০%। ব্রিটিশ আমলের নকশাকৃত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও নতুন ড্রেনেজ ব্যবস্থা নকশা ও প্রণয়নে অকার্যকর সেকেলে কার্যপদ্ধতির প্রাধান্য কেবল ঢাকার ২৬% এলাকার জন্যে যথেষ্ট। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ২০১০ সালের জলাভূমি আইন কার্যকর হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ঢাকার প্রায় বারোমাসি জলাবদ্ধতার অন্যতম মূল কারণ হলো জলাধারের পরিমাণ হ্রাস।
বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, জলাধার হলো পানি ধারণকারী প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম জলাশয়, যা অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণ করে জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং পানির নিষ্কাশন চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়।
মাত্র ৪ মিটার উচ্চতার সমতল ডেল্টা-ভূমির ঢাকায়, ২৬টি খাল ও ৪টি প্রধান নদী (বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা) একসময় বর্ষার পানি সহজে বের করে দিত। সাথে ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন মাপের জলাধার। ১৯৮৮ সালে জলাভূমি ঢাকার ৪৩% এলাকাজুড়ে ছিল, যা একেকটি প্রবল বর্ষণে ১৫০ কোটি লিটার পানি শোষণ করতে পারত। জনসংখ্যা ৬০ লাখ থেকে প্রায় ২.৫ কোটিতে পৌঁছানোর পথচলায়, জলাভূমিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ‘অব্যবহারযোগ্য জমি’ হিসেবে বালু-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা শুরু হয়। ১৯৯০-২০২০ পর্যন্ত ঢাকা ৬৯% জলাভূমি হারিয়েছে, খালের সংখ্যা ৬৫ থেকে ২৬-এ নেমেছে, যার ৬০% দখল ও বর্জ্যে ভরা। ঢাকা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান অনুযায়ী, নগর এলাকার প্রায় ২০% (প্রায় ২৯০ বর্গকিলোমিটার) জলাধার ও খালের জন্য সংরক্ষণ করা প্রস্তাবিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভয়াবহ। ২০২৩ সালে সায়েন্সডাইরেক্টে প্রকাশিত গবেষণা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (BWDB) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে ঢাকার জলাধারের পরিমাণ প্রায় ৬৯% হ্রাস পেয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) দীর্ঘ দুই বছর ধরে করা গবেষণায় দেখা গেছে, ‘ঢাকার জলাধারগুলোর এই করুণ অবস্থার পেছনে একাধিক কারণ জটিলভাবে জড়িয়ে আছে, যেখানে অব্যবস্থাপনা, দূরদর্শী ও ত্রুটিযুক্ত নীতি প্রণয়ন, দুর্বল নীতি বাস্তবায়ন এবং পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। নগর উন্নয়নের নামে রাজধানীর অসংখ্য প্রাকৃতিক জলাধার, খাল, বিল ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করে আবাসন প্রকল্প, বাণিজ্যিক অবকাঠামো এবং সড়ক নির্মাণ হয়েছে। যেমন আফতাবনগর, বনশ্রী, মহানগর প্রজেক্ট, বসুন্ধরা, উত্তরা দিয়াবাড়ি ৩য় প্রকল্প, বাড্ডা রাজউক পুনর্বাসন এলাকা (ডি আই টি প্রজেক্ট), হাতিরঝিল, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও বসিলাসহ ঢাকার নানা প্রান্তে একসময় বর্ষার পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, বর্তমানে সেগুলোর বড় অংশই ভরাট হয়ে গেছে।’
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কর্তৃপক্ষ কি জানত না, এ ভরাটের ফল একটা সময় এসে ঢাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে?
উত্তর হলো, দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো নিঃসন্দেহে জানত এবং জানে, কি হচ্ছে, কি হয়েছে এবং কি হবে। ঢাকার জন্য বিশেষজ্ঞ টিমের তৈরি নানা নীতিপত্র ও পরিকল্পনায় যেমন রাজউকের স্ট্রাকচার প্ল্যান ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) স্পষ্টভাবে জলাধার, নিম্নাঞ্চল ও খাল সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও নীতি-ভিত্তি উভয়ই ছিল। কিন্তু সেই নীতিগুলোর প্রয়োগ ও নজরদারিতে মারাত্মক ব্যর্থতা দেখা গেছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরিসংখ্যানেও এই সংকটের পূর্বাভাস ছিল। স্যাটেলাইট-ভিত্তিক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ জানায়, ১৯৯০-২০২০ সময়কালে ঢাকার ওয়েটল্যান্ডের প্রায় ৬৯% হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর জরিপে ২০১১-২০১৯ সালের মধ্যে অন্তত ৩,৪৮৩ একর জলাশয় ও নিম্নভূমি ভরাট বা হ্রাস পাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব তথ্য স্পষ্ট করে যে সতর্কবার্তা ছিল- কিন্তু বাস্তবে তা উপেক্ষিত হয়েছে। আইন না মেনে যখন জলাধার ভরাট হয়েছে, শহর কর্তৃপক্ষ কখনো দখলদারদের শোকজ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও, তা খুব কম ক্ষেত্রেই দ্রুত পুনরুদ্ধার বা প্রতিরোধে কার্যকর হয়েছে। সবশেষে, এটি অজ্ঞতার ফল নয়-বরং ‘জেনে ও জেনেও না করা’ (know-but-do-not-act)-এর উদাহরণ।
কিন্তু একটি আলাপ রয়েই যায়, সরকারিভাবে কি করে জলাধার ভরাট করে আবাসন তৈরি হল? যেমন, উত্তরা দিয়াবাড়ি ৩য় প্রকল্প, বাড্ডায় রাজউক প্রজেক্ট। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডিএ)-এর গবেষকদের মতে, রাজনৈতিক চাপ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও সরকারের আস্থাভাজনদের নামমাত্র মূল্যে প্লট প্রদান, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অযোগ্য ব্যক্তির পদায়ন, বিশেষজ্ঞ মতামতকে উপেক্ষা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এর মূল কারণ। সরকারি এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জলাধার ভরাটে উৎসাহ ও ন্যায্যতাও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও জানান তারা।
বিদ্যমান জ্ঞান ও নীতি থাকার পরও অর্থনৈতিক স্বার্থ, দুর্বল আইন প্রয়োগ, প্রশাসনিক অক্ষমতা ও অপর্যাপ্ত শাস্তির কারণে জলাধার ধ্বংস অব্যাহত থেকেছে। সংবাদপত্র, উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থাগুলোর দরুন জানা যাচ্ছে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো প্রয়োগকারী ও তদারকি সংস্থাগুলোর দুর্নীতি বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক, আইডব্লিউএমআই ও গবেষকরা বারবার সতর্ক করেছেন। যদি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়বে, জলাবদ্ধতার সমস্যা বহুগুণে বাড়বে এবং পুনরুদ্ধারের ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। এ জলাবদ্ধতা যে কেবল নাগরিক জীবনকেই অশান্ত করে তা নয়, জলাবদ্ধতা ও অনুরূপ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতি বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রতি ১ দিনে জলাবদ্ধতা থেকে সৃষ্ট ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ আর্থিক মূল্যে ১শ কোটি টাকার আশপাশে। ঢাকার জলাধার ভরাটে জীববৈচিত্র্যের হ্রাসও হয়েছে মূল পরিমাণের ৩০%। গত কয়েক বছরে ঢাকার ডেঙ্গুর আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বার পিছনেও বড় ভূমিকা রয়েছে ঢাকার জলাবদ্ধতার।
ঢাকার জলাবদ্ধতা কমাতে প্রথমত কঠোর আইন প্রয়োগ ও নজরদারি জরুরি, যেখানে রাজউক, সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করে অবৈধ জলাধার দখল, ভরাট ও দূষণ প্রতিরোধ করবে। দ্বিতীয়ত, পুরোনো জলাধার, খাল ও জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে হবে, নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে তাদের পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন প্রকল্প অনুমোদনের আগে অবশ্যই জলাধার সংরক্ষণের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। গবেষণা বলছে হারানো বা দখলকৃত খালের কেবল ২০% পুনঃস্থাপনের মাধ্যমেই ঢাকার জলাবদ্ধতা ৫০% কমানো সম্ভব। যার সর্বসাকুল্যে খরচ ৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ অন্য কত-শত চেষ্টায় আরও কতগুণ টাকা জলাবদ্ধতা ঠেকাতেই জলে গেল। তৃতীয়ত, নগর পরিকল্পনায় জলাধার ও নিম্নাঞ্চলের সুরক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং এই নীতি মেনে না চললে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। চতুর্থত, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বাড়াতে পরিবেশ এবং জলাধারের গুরুত্ব নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে তারা নিজেও ড্রেন, খাল ও জলাধারের সুরক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পাশাপাশি, ঢাকার নিকাশি ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাড়াতে নতুন জলাধার খনন ও বিদ্যমান খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এতে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি ধারণ ও নিষ্কাশন সহজ হবে ও বন্যার প্রবণতা কমবে। আধুনিক প্রযুক্তি যেমন জিআইএস ও স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং ব্যবহার করে অবৈধ দখল ও দূষণ দ্রুত শনাক্ত করে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সবশেষে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনিটরিং থাকে এবং সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত হয়। এভাবে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকার জলাধার পুনঃস্থাপন ও খাল সংরক্ষণ টেকসই নগরায়ণে সহায়তা করবে, জলাবদ্ধতা কমাবে এবং নাগরিক জীবনের মান উন্নত করবে।
লেখক : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রিসার্চ ফেলো, ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
মন্তব্য করুন