

জীবনের প্রতিটি পেশাগত সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের পথে একটি নতুন অধ্যায় খুলে দেয়। বিশেষ করে চাকরি বদল করার সিদ্ধান্ত— এখানে আবেগ নয়, যুক্তিই হওয়া উচিত মূল পথনির্দেশক। একটি প্রতিষ্ঠিত পদ ছেড়ে অন্য কোথাও যোগ দেওয়াটা শুধুই পদোন্নতি নয়; এটা নতুন সাংগঠনিক সংস্কৃতি, ভিন্ন নেতৃত্ব ও নতুন ঝুঁকির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ব্যাপারও বটে। সেই কারণে পেশাগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত ছয়টি বিষয় গভীরভাবে বিবেচনা করা জরুরি।
প্রথমত, পদ ও দায়িত্বের পরিধি : শুধু নতুন পদবির নাম বড় হওয়া মানেই উন্নতি নয়। দেখুন— নতুন পদে আপনার দায়িত্ব কতটা বেড়েছে? আপনি কৌশলগত সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার অংশ হবেন, নাকি কেবল পদের শিরোনাম বদলেই সীমাবদ্ধ? বাস্তব নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তগ্রহণে অংশগ্রহণ এবং দৃশ্যমান প্রভাব তৈরির সুযোগ থাকলে সেটিই হবে পেশাগত সঠিক সিদ্ধান্ত ও সত্যিকারের উন্নতি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও স্থিতিশীলতা : নতুন প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সুনাম ও আর্থিক-সংগঠনিক স্থিতিশীলতা যাচাই করুন। প্রতিষ্ঠানটি কি ভালো গভর্ন্যান্সে বিশ্বাসী? সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনিক সুনাম নিয়ে কোনো বিতর্ক বা ব্যবস্থাপনা সংকটে ছিল কি? প্রতিষ্ঠানের নীতি, নেতৃত্ব আর নৈতিক মূল্যবোধ আপনার ব্যক্তিগত মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা ভালো করে ভাবুন—কারণ অস্থিতিশীল বা বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলে আপনার পেশাগত বিশ্বাসযোগ্যতাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, কর্মপরিবেশ ও নেতৃত্বের ধরন : আপনি কাদের অধীন কাজ করবেন— এই প্রশ্নটি অ্যানালাইসিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যার অধীনে কাজ করবেন সেই নেতা কি দূরদর্শী ও সহায়ক, নাকি নিয়ন্ত্রক ও সেতুবন্ধন-হীন? ব্যবস্থাপনায় থাকা দলটি কি সহযোগিতামূলক, নাকি ব্যক্তিকেন্দ্রিক? একটি ভালো নেতৃত্ব দলের সদস্যদের স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করতে অনুপ্রেরণা দেয়; দুর্বল নেতৃত্ব থাকা মানে দীর্ঘমেয়াদে হতাশা ও ঘাটতির সম্ভাবনা বেশি।
চতুর্থত, ক্যারিয়ার প্রবৃদ্ধির পথ : বর্তমান প্রতিষ্ঠানে আপনার শেখার সুযোগ ও উন্নতির পথ এখনও খোলা আছে কি না সেটি মূল্যায়ন করুন। যদি দেখেন যে আপনি এখানে ‘ফিউচার লিডার’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন, তাহলে ধৈর্য ধারণ করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে। কিন্তু যদি আপনার অবস্থান গ্লাস-সিলিংয়ের মধ্যে আটকে থাকে, নতুন প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি বা দায়িত্ব বেড়ে ক্যারিয়ারে নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে। মনে রাখবেন— ক্যারিয়ার বৃদ্ধিই শুধু পদবির সংখ্যা বৃদ্ধি নয়; শেখার সুযোগ, কৌশলগত চিন্তার বিস্তার ও প্রভাব তৈরির সুযোগও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পঞ্চমত, আর্থিক ও ব্যক্তিগত বিবেচনা : চাকরি পরিবর্তনেপ ক্ষেত্রে বেতন, ইনস্যুরেন্স ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটিই একমাত্র বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ভ্যালু, ইন্ডাস্ট্রিতে অবস্থান এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের বিষয়টিও বিবেচনায় আনুন। অল্পকিছু সুবিধার জন্য দুর্বল ব্র্যান্ডে যোগ দিলে ভবিষ্যতে সুনামগত ঝুঁকি আসতে পারে। পদক্ষেপ নেওয়ার আগে পরিবারের দায়িত্ব, ভ্রমণ-দূরত্ব, কাজের সময় এবং জীবনের অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলোও বিচার করুন।
ষষ্ঠত, কৌশলগত মূল্য ও সুনামগত ঝুঁকি : কোন প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন বা আস্থার বেড়ানোর পর্যায়ে থাকলে সেখানে যোগ দেওয়া একই সাথে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ—উভয়ই। আপনি যদি সেই সংস্কারেও নেতৃত্ব দিতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি পাল্টাতে সক্ষম হন, সেটি হতে পারে আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু যদি সমস্যা মৌলিক ও অমীমাংসিত থেকে যায়, তখন সেটি আপনার সুনামের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে প্রভাব ফেলবে।
পরিশেষে, প্রতিষ্ঠান বদল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে চারটি সরল প্রশ্ন করুন—
ক. নতুন পদটি কি বাস্তবে কৌশলগত ক্ষমতা দিচ্ছে, নাকি শুধু পদের নাম পরিবর্তন? খ. প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব কি আপনার মূল্যবোধ ও সততার সঙ্গে মিলে? গ. প্রতিষ্ঠানের গভর্ন্যান্স ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আপনার আস্থা আছে কি? ঘ. বর্তমান প্রতিষ্ঠানে কোথাও উন্নতির সুযোগ সত্যিই নেই কি?
যদি এই চারটি প্রশ্নের উত্তর যদি ইতিবাচক হয়, তখন নতুন পদে যাওয়াটা নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলতে পারে। অন্যথায়, নিজের স্থিতি, সুনাম ও প্রভাব শক্তিশালী করতে বর্তমান প্রতিষ্ঠানে থেকে যাওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।
চাকরি বদল মানে নতুন রাস্তা বেছে নেওয়া— কিন্তু প্রতিটি রাস্তারই নিজস্ব গন্তব্য আছে। তাই সিদ্ধান্ত নিন যত্ন করে, কারণ আপনার প্রতিটি পদক্ষেপই গড়ে তোলে পেশাগত পরিচয়ের ভবিষ্যৎ।
লেখক : এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
মন্তব্য করুন