শিক্ষা, স্বাস্থ্য একটি দেশের নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার। আমরা যখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন শিক্ষা সম্পর্কিত দুটি স্লোগান দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত। এক- শিক্ষা আমার অধিকার, এ অধিকার সবার চাই, দুই- শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার। পরবর্তী জীবনে এসে বুঝেছি এই অধিকার নাগরিকদের দিয়েছে আমাদের দেশের সংবিধান। এই সংবিধান হলো সুপ্রিম ল’ অব দ্য ল্যান্ড। সংবিধান বেশ কয়েকবার সংশোধন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার অধিকার যা দেওয়া হয়েছে, তার নড়চড় হয়নি। মহান সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাকে নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ১৭নং ধারা অনুযায়ী নাগরিকগণের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
নাগরিকগণের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাথমিক থেকে টারশিয়ারি সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার করেছে। স্কুলে ড্রপ আউট কমেছে, নারী শিক্ষার অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়ভাবে হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেশের আনাচে-কানাচে হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় দেশের সব উপজেলা লেভেলেই আছে। এমপিওভুক্ত বেসরকারী স্কুলের সংখ্যাও ব্যাপক। সরকারি কলেজও দেশের প্রতি উপজেলায় আছে। এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজের সংখ্যাও অনেক। অর্থাৎ নাগরিকদের নাগালের মধ্যে স্কুল কলেজ আছে। সত্তরের দশকে স্কুল কলেজের অবকাঠামোর দশা বেহাল ছিল। টিনের ঘর, ভাঙা বেড়া ছিল তখনকার চিত্র। এখন সব স্কুল কলেজে পাকা দালান হয়েছে। দেশে সাধারণ শিক্ষার হার বেড়েছে অনেক। বর্তমানে এই হার শতকরা ৭৪ দশমিক দুই তিন। কিন্তু শিক্ষার মান বেড়েছে কি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
শিক্ষার অবকাঠামোই আসল না, আসল হলো শিক্ষা দান এবং শিক্ষাগ্রহণ। এখন বিদ্যালয়ের পাকা ভবন আছে, কিন্তু শিক্ষার মানের অবনমন হয়েছে। শিক্ষকদের আদর্শ দেখে ছাত্রছাত্রীরা উদ্বুদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের শিক্ষকগণের মধ্যে আজ সেই মানবিক আদর্শ নেই। একসময় ছিল শিক্ষকগণ হাতে শাসনদণ্ডের ন্যায় বেত নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেছেন। বেতের ব্যবহার তথা ছাত্রছাত্রীদের দৈহিকভাবে বেত্রাঘাত যেসব শিক্ষকই করতেন তা নয়। অনেকে বেত ছাড়াও ক্লাসে গেছেন, অনেক শিক্ষক ছিলেন, নিয়মিত বেত হাতে গেছেন, কিন্তু ছাত্রদের ওপর প্রয়োগ করেননি। এখন ক্লাসে বেত নিয়ে যাওয়ার বিধান নেই, কিন্তু বেত না নিয়ে গেলেও যে শিক্ষকের শিক্ষাদানের আপ্রাণ প্রয়াস, ছাত্রছাত্রীদের স্নেহ বা বকাঝকার মাধ্যমে শেখানো সেটাও আজ অনুপস্থিত দেখা যায়। আমরা যারা অভিভাবক, তারা সবাই জানি, আমাদের ছোটবেলায় শিক্ষকদের যে পরিমাণ সমীহ করতাম, তার পঞ্চাশ ভাগের একভাগও আজ নেই। এর অর্থ এই নয় যে, শ্রেণিকক্ষে বেত না নিয়ে যাওয়ার কারণে এটা হয়েছে। আসল কথা হলো শিক্ষকদের সেই ত্যাগ বা ডিভোশন নেই পাঠদানে। অনেক শিক্ষক নিজে তার শিক্ষকতার চাকরিটি পেয়েছেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটিকে ঘুষ বা ডোনেশন দিয়ে। এ কারণে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন এখন সম্মানের জন্য করে না, আর্থিক লাভের জন্য করে থাকে।
শিক্ষকগণ ক্লাসে সঠিকভাবে পড়ালে প্রাইভেট পড়ানো তথা কোচিং ব্যবসা এত রমরমা হতো না। প্রত্যেক অভিভাবককে প্রাইমারি থেকে হায়ার সেকেন্ডারি স্তর পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে সর্ব বিষয়ে কোচিং দিতে হয়। এটা একটা অলিখিত স্থায়ী নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। কোচিং বাণিজ্য শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করেছে। নব্বই দশক থেকে, ক্রমান্বয়ে গভীরতরভাবে এই প্রক্রিয়া জেঁকে বসেছে। চোখের সামনে দেখছি, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। শিক্ষকগণ এখন ক্লাসে আন্তরিকতার সাথে না পড়িয়ে কোচিং করাতে রত। তাতে নগদ উপরি প্রাপ্তি ঘটে। অভিভাবক ছাত্রছাত্রী অসহায়। প্রাইমারি, হাইস্কুল ও কলেজ সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি কোচিং, ভর্তি হয়ে পাস করার জন্য কোচিং। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকা ফি দিয়ে কোচিং এ ভর্তি হতে হয়। ফলে আপনার বাচ্চা শুধু মেধাবী হলে চলবে না, আপনাকে টাকা গুনতে হবে কোচিং এর জন্য। এ এক চরম অন্যায্য ব্যবস্থা।
একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল প্রকার কোচিং ব্যবসা ও কোচিং প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া উচিত। একজন ছাত্র যখন দেখছে, ক্লাসে শিক্ষক ঠিকমতো পড়ান না, কোচিং এ পড়ান বাড়তি অর্থের বিনিময়ে, তখন সেই শিক্ষকের প্রতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনোক্রমেই ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ আসতে পারে না। এটি ইউনিভার্সাল ট্রুথ।
সামাজিক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, সদাচরণ, গুরুজনকে সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, এসবও শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। আমি যখন দেখব, আমার শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত, যখন দেখব, শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট কোচিং করলে আমি প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাই, আর প্রাইভেট কোচিং না করলে কম নম্বর পাই, তখন শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পাবেই বা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শিক্ষক নিয়োগে হয় দুর্নীতি। শিক্ষক নিয়োগে মেধার সাথে নৈতিক চরিত্র বিবেচনা তো করা হয়ই না, নিরপেক্ষভাবে মেধা যাচাইও হয় না। এমতাবস্থায়, এই সব শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে পাস করে আমি মানবিক শিক্ষক, মানবিক কর্মকর্তা, মানবিক ডাক্তার, মানবিক প্রকৌশলী, মানবিক ব্যবসায়ী হওয়ার আশা করলে তা দুরাশা হবে এটাই স্বাভাবিক।
শরীফ শেখ: লেখক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
মন্তব্য করুন