আবুল কাসেম ফজলুল হক; প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, লেখক, গবেষক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক, নীতিবাদী রাজনৈতিক দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক। তিনি নিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তার রচনা স্বদেশ ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তায় ঋদ্ধ। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন অধ্যাপক এবং বাংলা বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একুশটিরও অধিক গ্রন্থের প্রণেতা ফজলুল হক নজরুল রচনাবলির সম্পাদনা পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্র-পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। তিনি ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্বদেশ চিন্তা সংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সংগঠনটিকে সৃষ্টি করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান মুক্তচিন্তক আহমদ শরীফ। এ ছাড়াও এ সংগঠনটি ‘বাংলাদেশের মুক্তি ও উন্নতির কর্মনীতি আটাশ দফা’ ১ জানুয়ারি, ২০০৫ থেকে প্রচার করে যেটির রচয়িতা ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশীয় রাজনীতির দুবর্লতা, রাজনৈতিক দল ও বিদেশিদের ভূমিকা নিয়ে কালবেলার সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন।
কালবেলা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এর কারণ কী এবং এখান থেকে উত্তরণের উপায় কি?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : বাংলাদেশের প্রধান ৩টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে মূলত এই ৩টি রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে সরকারি ক্ষমতায় আছে এবং ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের উন্নতি এবং জনজীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য যে চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি থাকা দরকার তা এই ৩টি দলের কারও নেই। আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছে এবং এর আগেও তারা পাঁচ বছর ও সাড়ে তিন বছরের মতো ক্ষমতায় ছিল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের অভিজ্ঞতাও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে তারা অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করতে পেরেছে। দেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে, মেট্রোরেল হয়েছে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল হয়েছে, মানুষের দৃষ্টিতে এগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য আমরা অবশ্যই শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাই। কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই দুর্বল হয়েছে।
কিছু প্রশ্নে আমাদের গোটা জাতির ঐকমত্য দরকার। ১৯৮০-এর দশকেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় ঐক্য এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যের চিন্তা মানুষের মনে তৈরি করা হয়নি। সকল মতের মানুষকে নিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রয়োজন ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সেটা গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের আশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্য তৈরিতে কাজ করেনি। আর বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির কাছে আমাদের আশা তুলনামূলকভাবে কমই ছিল। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল তারাও কিছু উন্নয়ন করেছে। এরশাদ টানা ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের কৃষি ব্যাপক উন্নতি লাভ করে এবং আমাদের ফসল উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বাংলাদেশের খাদ্যাভাব কমে গিয়েছিল। মানুষের পরিধানের কাপড়ের অভাব কমেছিল। এগুলো এরশাদকে টানা ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার একটি বাস্তব ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
বিএনপি কোনো পরিছন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য তৈরি করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ বিরোধীমতের মানুষ বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিএনপি বাংলাদেশের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠেনি। আর জাতীয় পার্টি বলা যায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটের মধ্যেই রয়েছে।
একটি রাষ্ট্রে জাতীয় ঐক্য এবং জনজীবনের সমস্যাগুলো সমাধান করাই রাজনীতির কাজ। মানুষের উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এবং তা বাস্তবায়ন সরকারের কাজ। আর সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই দল গঠনের প্রস্তুতি অন্য দলগুলোর মধ্যে নেই, এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। কিন্তু কেবল ঐতিহ্য নিয়ে একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখা যায় না। বরং বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু সেই চিন্তাটি এখন পর্যন্ত স্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না।
কালবেলা : যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : নানা কারণে বাংলাদেশকে সঙ্গে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইন্দোপ্যাসিফিক পিস অর্গানাইজেশন নামে একটি পলিসি গ্রহণ করেছে। সেখানেও বাংলাদেশকে সঙ্গে নিতে চায় আমেরিকা। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত। ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। ফলে বাংলাদেশ আমেরিকার বলয়ে যেতে চাইছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তরের কথা হলো নিজেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য ইন্দোপ্যাসিফিক পিস অর্গানাইজেশনের সদস্য হবে না বাংলাদেশ। আমি একে সমর্থন করি। কারণ, আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখব এবং কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা বা শত্রুতার সম্পর্কে যাব না। শেখ হাসিনার এই নীতি প্রশংসনীয়। তবে আমি বাংলাদেশের যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি সেটা আওয়ামী লীগের বিবেচনার মধ্যে নেই। তারা চাইছেন সকল মানুষ একমাত্র আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে। কিন্তু এটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।
ব্রিটিশ শাসনের সময়েও আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের অনেকেই যারা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বুদ্ধিজীবী তারা ইংরেজদের, আমেরিকানদের এবং ফ্রান্স, জার্মানির রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। সেই ঐতিহ্যটি আজ নানাভাবেই আমাদের মন-মানসিকতার মধ্যে রয়ে গেছে। ফলে দেশের সকল মানুষ কেবল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং শুধু আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করবে এটা চাইলেও হবে না। চাইলেও সকলকে একদলীয় করা সম্ভব নয়। দেশে বিএনপির একটি বড় জনসমর্থন রয়েছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী বিএনপির দলটি গড়ে ওঠেনি। বিএনপির নেতৃত্বের জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ একটি বড় দল হিসেবেই ছিল এবং রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে ভিতর থেকে দুর্বল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ভিতর দ্বিতীয় কোনো নেতৃত্ব নেই। বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা লাভ করবে এমন কোনো নেতা নেই। একজন নেতার যে ধরনের গুণাবলি থাকা দরকার যেমন- সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা লাভ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া, দেশবাসীকে পরিচালনা করা, জনজীবনের সমস্যা সমাধান করা এবং রাষ্ট্র ও জাতিকে শক্তিশালী করা এই চিন্তাভাবনাই এখন কারও মধ্যে নেই।
এখন যারা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তারা কেউ কেউ শেখ হাসিনার চেয়েও বয়সে বড়। রাজনীতি করার জন্য তাদের যে চিন্তাভাবনা ও সক্ষমতা দরকার বয়সের কারণে তারা সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। এটিই বাস্তবতা। আমেরিকা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শিখিয়েছে, ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনই গণতন্ত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্রের ধারণা এটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা আরও বিস্তৃত ছিল। মাওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তারাও গণতন্ত্রের এটুকু ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তারা মনে করতেন, গণতন্ত্র মানে- জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্র, জনগণের কল্যাণে প্রশাসন, জনগণের কল্যাণেই শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ সবকিছুই। অর্থাৎ গণতন্ত্র মানে জনগণের কল্যাণে, জনগণের জন্য এবং জনগণের রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু, ভাসানী কিংবা শেরেবাংলা গণতন্ত্রের যে ধারণা পোষণ করতেন এখন সেই ধারণা অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। আমাদের রাজনীতির ভেতরে প্রকৃত রাজনীতি নেই এটাই গণতন্ত্রের দুর্বলতার কারণ।
আজ আমেরিকা বা ইউরোপের লোকেরা ঢাকায় এসে যেভাবে কথা বলছেন, যেভাবে প্রেস কনফারেন্সিং করছেন সেটা কোনোভাবেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সম্ভব নয়। বিরোধীরাও এসব বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ জানায় না বরং সমর্থন করে। অথচ আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বিদেশিরা কথা বলবে বা হস্তক্ষেপ করবে সেটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমরা মনে করি অবিলম্বেই বিদেশিদের আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলা থেকে সরে যাওয়া উচিত।
কালবেলা : বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে প্রশ্ন থাকায় বিরোধীদলগুলো বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যালোচনা কী?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : আমরা যদি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির রাজনীতি লক্ষ্য করি তাহলে সেখানে অনেক কিছুই দেখতে পাই। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে যেমন বিদেশিদের কাছে গেছে, বিএনপিও গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। বিএনপিও বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসগুলোর কাছে সহায়তা চেয়েছে। কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধিকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। তিনি ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে এবং সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা মিটিং করেছেন, কীভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। এখানকার সাংবাদিক এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা তেমন কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। আমি তখন লিখেছিলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো বিদেশির এভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করা উচিত নয়। বিদেশিরা বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে সেটা আমাদের জাতীয় রাজনীতির সীমাহীন দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে বিদেশি শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সে অবস্থা থেকে বের হওয়া দরকার। কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়েই এ সমস্যার সমাধান হবে না। একটি সুস্থ নির্বাচন করার জন্য এবং দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠার প্রস্তুতি দরকার। একসময় এই প্রস্তুতি আমরা দেখেছি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্ব, দেখেছি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে দল গঠনের চেষ্টা, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, আগরতলাসহ অন্যান্য জায়গায় আমরা কমিউনিস্ট পার্টির দল গঠনের নেতৃত্ব দেখেছি। আমাদেরও দেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপরেখা জনগণের সামনে আনা উচিত। বিষয়টা অনেক কঠিন মনে হলেও আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো দল যদি সেটা চেষ্টা করে তবে সেটি একেবারেই কঠিন নয়।
কালবেলা : বাংলাদেশে একটি দল আরেকটি দলকে বিশ্বাস করে না অর্থাৎ পারস্পরিক আস্থাহীনতা বিদ্যমান। এখান থেকে উত্তরণ ঘটানো কী সম্ভব?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : একটি দল আরেকটি দলকে বিশ্বাস করে না, এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় দুর্বলতা। এই অবিশ্বাসের কারণে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদ একটি অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল গঠন করেছিলেন। সে কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কাউন্সিলের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ছয়/সাতজন নেতাও ছিলেন। সেই কমিটিতে আরও কিছু মানুষকে যুক্ত করে জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করা যেত। তারা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই কমিটিকে আর সচল রাখা হয়নি। এখানে আমাদের জাতীয় দুর্বলতার একটি পরিচয় দেখা যায়। জাতীয় ঐক্য না থাকলে বিদেশি শক্তিগুলো ঘাড়ে চড়ে বসতে চেষ্টা করে।
কালবেলা : বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান কীভাবে আসতে পারে?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : এটার জন্য প্রথমেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সেই সংস্কার যেমন আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে আসছে না তেমনি অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে থেকেও আসছে না। বিএনপিরও উচিত দল গঠনের জন্য এরকম সংস্কারের চিন্তা ভাবনা করা। দেশে বিএনপির অনেক সমর্থক রয়েছে। বিএনপি যদি আরও পাঁচ বছর আগে থেকে রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন এবং জনজীবনের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করত তাহলে বিএনপি আরও জনপ্রিয় হয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারত।
কালবেলা : বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো কেন এত চিন্তিত হলো?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : গত ১০-১৫ বছরের বিএনপি নেতারা একপ্রকার অন্ধভাবে আমেরিকার হয়ে কাজ করেছেন। তারা বারবার ওয়াশিংটনে গিয়েছেন এবং তদবির করেছেন। ফলে বিএনপির অতিরিক্ত আমেরিকা নির্ভরতা বিএনপির গুরুত্ব কমিয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকেও আমেরিকা খুব একটা পছন্দ করছে না।
কালবেলা : বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : বিএনপি একটি দ্বিমুখী সংকটে পড়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গেলেও সেটা তাদের জন্য ভালো হবে না বা তারা দুর্বলতার মধ্যে পড়বে। অন্যদিকে নির্বাচনে না গেলেও তারা দুর্বল হবে। বিএনপি রাজনীতিবিহীনভাবে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তাকে জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন বক্তব্য দিয়ে জনগণের মন জয় করে ক্ষমতায় আসতে হবে। চোরাগুপ্তা কোনো পন্থায় ক্ষমতায় আসা বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগ যেহেতু একটানা ১৫ বছর যাবৎ ক্ষমতায় রয়েছে ফলে তারা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
কালবেলা : পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে ওঠার শঙ্কা কতটা?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : সহিংসতার পরিবেশ এখনই বিদ্যমান। কিন্তু আমেরিকার চাপের কারণে দুই দলই সংযত অবস্থায় রয়েছে এবং সহিংসতা কম দেখাচ্ছে। তার পরেও দেখা যাচ্ছে প্রতিমাসেই ৫-৭ জন মানুষ মারা যাচ্ছে মিছিল সমাবেশ বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তবিরোধের কারণে এসব মানুষ মারা পড়ছে। এটাও এক ধরনের সহিংসতা এবং এটা আরও বাড়াতে পারে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। সুতরাং নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। সহিংসতা যদি ভয়ানক পর্যায়েও চলে যায় তবে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে মনে হয়।
কালবেলা : রাজনীতির এ ডামাডোলে মানুষ কোথায়?
আবুল কাশেম ফজলুল হক : মূল্যস্ফীতি, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, লুটপাট, দুর্নীতি সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে রাজনৈতিক বক্তব্য আগে ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থীরা এই বক্তব্য বেশি ধারণ করতেন। কারণ বামপন্থিরা কখনোই ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি করেনি। কিন্তু তারা অন্যায় এবং অবিচারের প্রতিবাদ সবসময়ই করেছে। কখনো কখনো তাদের প্রতিবাদ কার্যকর হয়েছে এবং সফল হয়েছে। কিন্তু বামপন্থিদের সে রকম শক্তি এখন আর নেই। তাদের তেমন কোনো বক্তব্যও এখন আর নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন যে ধারায় চলছে এই ধারায় সমস্যার সমাধান করার জন্য আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং আমেরিকা— এই তিনটা শক্তির উপর নির্ভর করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংলাপে যেতে রাজি নয়। আর বিএনপি জানে তারা কোনো আবেদন করলেও সরকার সেটা শুনবে না। ফলে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকেও সে রকম কোনো কম্প্রোমাইজিংয়ের কথা বলা হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একটি যথার্থ বিপর্যয়ের মধ্যেই রয়েছে। আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় বা নীতি নির্ধারণে বুদ্ধিজীবীদের একটি ভূমিকা ছিল। এখন তারা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন করে বিদেশি সাহায্যের উপর চলছেন। এভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না। জনমানুষের কথা ভাবতে হলে এবং ধারাবাহিকভাবে দেশের উন্নতি করতে হলে যে সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দরকার সেটা আমরা দেখছি না। জনজীবনকে বাদ দিয়ে, জাতীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বাদ দিয়ে রাজনীতির উন্নতি হবে না। ধীরে ধীরে রাজনীতির অবনতি হচ্ছে এবং এটা চলমান থাকবে। আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চাই। সেই প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্যান্য দলও করতে পারে।
রাজনীতির উন্নয়ন করতে হলে গণতান্ত্রিক ধারায় যেতে হবে। যারা বিদেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে তাদের বাদ দিয়ে অন্য সকল দল-মতের মধ্যে একটি ঐক্য প্রয়োজন। ব্যবসায়ীসহ সমাজের ধনীদের একটি সম্মানজনক অবস্থানের জন্য এই গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিকে সমর্থন করা উচিত। একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকার জন্য তাদের উচিত জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। তারা যেহেতু দেশ থেকে সম্পদ অর্জন করেছেন। জনগণের জন্য তাদের কিছু ব্যয়ও করতে হবে। সমাজের একটি সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখার জন্য তাদের এটা করতে হবে। সমাজের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষসহ খেটে খাওয়া মানুষদের স্বার্থকেও অবজ্ঞা করা যাবে না। তারাও যাতে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে তাদের আয় এবং বেতন যাতে সে রকম হয় সেজন্য চেষ্টা করতে হবে।
রাজনীতি একটি জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতি এবং সরকার ভালো হলে জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাজনীতি এবং সরকার দুর্বল হলে জাতীয় উন্নতির সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। আমরা সেই সীমিত থাকা অবস্থায় পড়ে গেছি। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কল্যাণমূলক গঠন জরুরি।
শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম
মন্তব্য করুন