রুবাইয়াত সানজিনা রানিলা ও জারিন তাসনিম ঐশী
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ০৯:২৪ পিএম
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৩, ০২:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বৈশ্বিক অর্থায়ন নিয়ে প্যারিস সামিট ২০২৩ : দেশের তরুণ ও বিশেষজ্ঞদের ভাবনা

রুবাইয়াত সানজিনা রানিলা (বায়ে) ও জারিন তাসনিম ঐশী। ছবি : সংগৃহীত
রুবাইয়াত সানজিনা রানিলা (বায়ে) ও জারিন তাসনিম ঐশী। ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। ফলশ্রুতিতে, ২০২২ সালের অনুমান অনুযায়ী ২০২৩-২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থায়নের প্রয়োজন হতে পারে। এর ‘সবুজ’ খাতকে উদ্দীপিত ও প্রসারিত করতে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং বিনিয়োগের। সাম্প্রতিক প্যারিস সম্মেলনকে লক্ষ্য করে বাংলাদেশের ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ), যা নীতিবিষয়ক গবেষণা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অভিজ্ঞ মতামত জানতে দুটি ওয়েবিনার পরিচালনা করে। তার মধ্যে প্রথমটিতে উপস্থিত ছিলেন জাহিদ আমিন শাশ্বত (উত্তরণের স্থানীয় যুবনেতা), সুমাইয়া বিনতে ফেরদৌস (ইয়ুথ অ্যামপাওয়ারমেন্ট ইন ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যাটফর্ম), সোহানুর রহমান (ইয়ুথ নেট গ্লোবাল), ওয়ারেফতা-ই-মুর্শেদ (গ্রস ইন্টারন্যাশনাল ন্যাচার) এবং সঞ্চালনায় ছিলেন জারিন তাসনিম ঐশী, ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলার এবং ওয়াইপিএফ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ পলিসি টিমের অ্যাভোকেসি লিড।

দ্বিতীয় ওয়েবিনারে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সাবের হোসেন চৌধুরী (মাননীয় সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত), ম্যারি মাসদুপুই (বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত), ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী (সংসদ সদস্য এবং চেয়ারপারসন, অভিবাসনবিষয়ক সংসদীয় ককাস), তাবিথ আউয়াল (নির্বাহী কমিটি সদস্য, বিএনপি), হুবার্ট ব্লোম (বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডেলিগেশনের অ্যাটাসে), ড. সেবাস্টিয়ান গ্রোহ (সিইও, সোলশেয়ার লিমিটেড)-সহ বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল—যেখানে সঞ্চালনা করেন আঞ্জুম নূর চৌধুরী, এমএসসি, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন এবং রিসার্চ লিড, ওয়াইপিএফ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ পলিসি টিম।

প্যারিস সম্মেলন মূলত দুদিনের একটি অনুষ্ঠান, যা ২০২২ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২২-২৩ জুন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ৫০টিরও বেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনটি মূলত ২০২২ সালে বার্বাডোসে অনুষ্ঠিত ব্রিজটাউন উদ্যোগ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কারসহ ঋণ, জলবায়ু এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট মোকাবিলায় কাজ করা।

প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের মতে দরিদ্র দেশগুলোকে অর্থায়নের বিষয়ে কিছু দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়া জরুরি। ব্রেটন উডস চুক্তির দ্বারা বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিষ্ঠা করার প্রায় নব্বই বছর পর, নেতারা যে দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন তাদের জন্য বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে আরও বেশি অর্থায়নের লক্ষ্য স্থির করেছেন।

প্যারিস সম্মেলন ২০২৩-এর মূল উদ্দেশ্য হলো:

• স্বল্পমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন দেশগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা;

• উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি খাতের উন্নয়নকে উন্নীত করা;

• সবুজ অবকাঠামো এবং কম-কার্বন শক্তি পরিবর্তনে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা;

• জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উদ্ভাবনী অর্থায়ন প্রচার করা।

শীর্ষ সম্মেলনের উদ্দেশ্যগুলোকে কেন্দ্র করে, ওয়াইপিএফ কিছু সুযোগ চিহ্নিত করেছে যার মধ্যে প্রধান হলো স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে গুরুত্বারোপ করা। পাশাপাশি আরও যেসব সুযোগ চিহ্নিত করেছে যেখানে জলবায়ু অর্থায়ন করা যেতে পারে: কার্বন এবং শক্তি উৎপাদনশীলতা উন্নত করা, উপাদান-উৎপাদনশীলতা উন্নত এবং গ্রিন ফিন্যান্সিং তথা সবুজ অর্থায়নের সুযোগ প্রসারিত করা। এ ছাড়াও আলোচনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল জলবায়ু অর্থপ্রবাহের পদ্ধতিগত সমস্যা, জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থায়ন দাবির ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করার প্রয়োজনীয়তা।

তরুণ প্যানেলের আলোচনার সারাংশ

১. আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলগুলোর অর্থ তৃণমূল সংস্থাগুলোর কাছে পৌঁছায় না: আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে যে শুধু যোগ্যতার মানদণ্ড বেশ কঠোর তা নয়, বরং আবেদন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।

সুপারিশকৃত নীতি: জলবায়ুকর্মী এবং তৃণমূল সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত জলবায়ু তহবিল সংগ্রহ করতে এবং আন্তর্জাতিক অনুদানের জন্য আবেদন করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক জ্ঞানের পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধি করাও আবশ্যক।

২. বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়ন সহায়তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পৌঁছালেও এর জন্য যে সংস্থাগুলো অর্থায়ন পায় তাদের অধিকাংশ ঢাকাকেন্দ্রিক। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সমস্যাগুলো সঠিকভাবে সমাধান করা সম্ভব হয় না।

সুপারিশকৃত নীতি : সারা বাংলাদেশে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত অর্থায়ন বরাদ্দ করার জন্য ম্যাপিং পরিচালনা করা প্রয়োজন। তদুপরি প্রশাসনিক এবং অবকাঠামোগত সক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তারও প্রয়োজন যাতে অভিযোজন অর্থায়নের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন এলাকায় পৌঁছানো যায়।

৩. স্থানীয় গবেষক, সরকার এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবধান জলবায়ু অভিযোজনে সমন্বিত এবং কার্যকর পদক্ষেপকে বাধা দেয়। সুপারিশকৃত নীতি : কর্মী, তৃণমূল সংস্থা, শিক্ষাবিদ, সরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদার প্রমুখের মধ্যে নিয়মিত সংলাপ, কর্মশালা প্রভৃতির আয়োজন করে যোগাযোগের ব্যবধান পূরণ করা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞ প্যানেল হাইলাইট

১. বাংলাদেশের জন্য আরও অভিযোজন অর্থের প্রয়োজন: ২০২২ সাল পর্যন্ত গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের (জিসিএফ) মতো বিভিন্ন বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে বাংলাদেশ মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান পেয়েছে, যা তহবিলের কঠোর মানদণ্ড এবং সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কারণে হয়েছে।

সুপারিশকৃত নীতি : প্রথমত, বাংলাদেশকে তার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোকে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের জন্য যোগ্য করে তুলতে আন্তর্জাতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়তা অনুসরণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে আরও অর্থায়নের যোগ্যতার মানদণ্ডের পক্ষে কথা বলতে হবে।

২. ‘অভিযোজন সহায়তা’-এর একটি প্রমিত সংজ্ঞার প্রয়োজনীয়তা: অনেক সময় ধরে আমরা এর অভাব বোধ করছি। কেননা এর জন্য কার্বননির্ভর প্রকল্পগুলোকে জলবায়ু সহায়তা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

সুপারিশকৃত নীতি: প্রথমত, ‘অভিযোজন সহায়তা’-এর একটি প্রমিত সংজ্ঞা স্থাপন করতে হবে যার জন্য বাংলাদেশ ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশ এবং ইইউর সঙ্গে একটি জোট গঠন করতে আগ্রহী।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু অভিযোজনে প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা নির্দিষ্ট করে প্রকল্প-স্তরের মেটাডেটাসহ অভিযোজন অর্থের জন্য একটি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ট্র্যাকিং সিস্টেমদাতা এবং প্রাপক দেশগুলোর মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে।

৩. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের একটি স্বাস্থ্যকর আর্থিক স্থান প্রয়োজন: গত সাত বছরে বাংলাদেশের জলবায়ুসংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দ মাত্র ১.১% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে এটি ২০২৩-২০৫০ এর মধ্যে ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অভিযোজন চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে না।

সুপারিশকৃত নীতি: প্রথমত, বাংলাদেশকে অনুদানভিত্তিক বা ব্যাপকভাবে রেয়াতযোগ্য জলবায়ু সহায়তা এগিয়ে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এটিকে তার আর্থিক জায়গার চাপ কমাতে বিদ্যমান উন্নয়ন ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে যার একটি উপায় হলো—ডিবেট ফর ক্লাইমেট (ডিএফসি) অর্থাৎ ‘জলবায়ুর জন্য ঋণ’ অদলবদলের মাধ্যমে যেখানে বহিরাগত ঋণ প্রদানগুলো গার্হস্থ্য জলবায়ু প্রকল্পগুলোর দিকে পুনঃনির্দেশিত করা যেতে পারে।

৪. বাংলাদেশের ‘সবুজ’ খাতে স্বল্প বিনিয়োগ: সবুজ খাত যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি, শক্তি পরিষেবা কোম্পানি (ইএসসিওএস), প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্ল্যান্ট ইত্যাদি এখনো বাংলাদেশে তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বিমা এবং অন্যান্য ঝুঁকি ভাগাভাগি প্রক্রিয়ার অভাব স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিনিয়োগকারীদের সবুজ সেক্টরে জড়িত হতে বাধা দেয়—কেননা এর জন্য প্রয়োজন বিপুল অর্থ।

সুপারিশকৃত নীতি: প্রথমত, বাংলাদেশের সবুজ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) গার্মেন্টস সেক্টরে তাদের বিদ্যমান উৎপাদনের অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে। বাংলাদেশি এবং ইইউ উভয় প্রতিনিধিই সর্বোত্তম অনুশীলন এবং প্রযুক্তিগত বিস্তারের বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের সবুজ খাতে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগে সহায়তা করতে হবে। বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশের বাজারে কোনো সবুজ পণ্যের চাহিদা রয়েছে তাও খতিয়ে দেখতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বাংলাদেশকে সহায়তা করতে হবে। তৃতীয়ত, সরকার থেকে সরকার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগিতার পাশাপাশি, সবুজ খাতবিষয়ক জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত বিস্তারকে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশের সরকার, এর ব্যবসা এবং বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো অতীব জরুরি।

ওয়েবিনারে প্যারিস সম্মেলন নিয়ে আলোচনার পর বক্তারা তাদের মূল্যবান দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। সাবের হোসেন চৌধুরী, সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত বলেন, ‘প্যারিস সম্মেলন থেকে আমরা কী গ্রহণ করি তা গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেইলআউট করতে ইচ্ছুক কিন্তু প্রকৃতিকে বেইলআউট করতে রাজি নই।’ আমরা শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার নই, আমরা সমাধানের অংশও। উন্নত দেশগুলো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী বটে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো কার্বন নির্গমনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদন করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্গমন শেষ পর্যন্ত কার্বন নির্গমনের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলোকে দখল করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের একটি বড় অংশ হতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। অতএব, আমাদের নীতির সমন্বয় থাকা দরকার, তিনি যুক্ত করেন। পরে তাবিথ আউয়াল, নির্বাহী কমিটির সদস্য, বিএনপি, জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের জলবায়ু প্রতিক্রিয়াশীল এবং সমাধানের একটি অংশ হতে হলে পুরো একটি সাপ্লাই চেইন দরকার।’ এ ছাড়া তার মতে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে অর্থায়নের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো সরাসরি জলবায়ুভিত্তিক ব্যবসা যেমন—পুনর্ব্যবহারযোগ্য, পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ। অপরটি হলো, ট্রানজিশন। কিন্তু ট্রানজিশনে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি, দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা সম্ভব নয়।

এ ছাড়া সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী একপর্যায়ে উল্লেখ করেন, ‘যখনই কোনো সবুজ বা ইকো প্রকল্পের কথা আসে, তখন যোগ্যতার মানদণ্ড কমানো এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি বিনীত হওয়া দরকার এবং একে সচরাচর ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক উদ্যোগের মতো দেখা ঠিক নয় কারণ জলবায়ুবান্ধব ব্যবসায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’

তবে এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়—যার জবাবে তাদের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি জোট হওয়া প্রয়োজন যাতে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়।’ হুবার্ট ব্লম, অ্যাটাশে, প্রোগ্রাম ম্যানেজার—গ্রিন ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল।

আলোচনা সাপেক্ষে সম্ভাব্য যেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে—

যুব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন: জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের যেসব যুব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণত কোনো আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয় না। আবার বিদেশ থেকে সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপ করে দেওয়া হয়। যেমন—বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) হিসেবে নিবন্ধিত হতে হবে, আবার এনজিও হলেও প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট ডেলিভারি ব্যতীত অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা যাবে কিনা সেটাও একটি উদ্বেগের বিষয় বটে। তাই যুবসংঘগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি সহায়তার বিকল্প নেই বললেই চলে।

এ ছাড়া করারোপে এদের কিছুটা ছাড় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ এরা স্বল্পমেয়াদি ও যৎসামান্য একটা ফান্ড পায়। তদুপরি সেখান থেকে প্রায় ২০-৩০% কেটে নিলে সংস্থাগুলোর জন্য বিদ্যমান অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা বা এর মধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এটা কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। জলবায়ু অ্যাকশন: জলবায়ুকে শুধু অভিযোজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা ভালো ফলাফল দিতে সক্ষম হবে। জলবায়ু অ্যাকশনে যে দিকগুলোতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে—প্রথমত, আমাদের যেই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলো আসে সেগুলো অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আসে।

দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কাজ করার সুযোগও তৈরি করে দিতে হবে। তৃতীয়ত, আমাদের তরুণদের মধ্যে প্রতিশ্রুতির অভাব অনেকাংশে পরিলক্ষিত। আমাদেরও পেশাদারিত্বেও গ্যাপ আছে।

এ সমস্যাবলিকে চিহ্নিত করে যদি আমরা তরুণদের জন্য কথা বলার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে ভালো ফলাফল আসবে। ক্যাপাসিটি গঠনে কতিপয় দক্ষতা: প্রথমত, দৃঢ় আকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন হতে হবে। উন্নয়ন ঢাকায় বসে করা যায় না, এর জন্য গ্রামে আসতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে চাইলে প্রথমে বুঝতে হবে জলবায়ু অর্থায়ন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কীভাবে কাজ করে, সেখানে অর্থায়নে কোথায় কোথায় গ্যাপ আছে, এগুলো থেকে উত্তরণের উপায়।

জলবায়ু সংকট সমাধানে সংলাপ: জলবায়ু সংকট শুধু পরিবেশগত সমস্যা নয়। বরং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সমস্যা ও বটে। ফলশ্রুতিতে জলবায়ু অর্থায়ন আবশ্যক যার জন্য আলাপ আলোচনা করতে হয় কিন্তু সবসময় শুধু আলোচনা দিয়ে সবকিছু আদায় করা যায় না, মাঝে মাঝে আন্দোলন এরও প্রয়োজন পড়ে।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে ধনী রাষ্ট্রগুলো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল যে তারা ২০২০ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থায়ন ব্যবস্থা করবে কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারও ঠিকমতো জোগাড় করতে পারেনি। বাংলাদেশে ২০১৫-২০২০ পর্যন্ত অর্থ এসেছে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—যার মধ্যে জাপান দিয়েছে ৭.৪৬ বিলিয়ন। এর মধ্যে ২.৪ বিলিয়ন বিনিয়োগ করেছে মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে। প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি: আমাদের প্রযুক্তির উদ্ভাবনে কিছুটা ঘাটতি আছে। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আমরা এক্সপেরিমেন্টে যেতে চাই না। কিন্তু যদি প্লাস্টিকজাত পণ্যের ব্যবহার কমাতে এর বিকল্প নিয়ে আসতে হবে যার জন্য এক্সপেরিমেন্ট বিকল্প নেই।

এখনই সময় চ্যারিটি মডেল থেকে বের হয়ে ব্যবসায়িক মডেলের দিকে দৃষ্টিপাত করা কিন্তু পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন মানুষ তার প্রাথমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।

পরিশেষে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অর্থায়ন ব্যবস্থাটা আমাদের দেশের জন্য সহজতর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। সেই সঙ্গে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা, গবেষণার জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করাসহ উপরোল্লিখিত অন্যান্য কতিপয় সুপারিশকৃত নীতিমালা বা পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্যারিস সম্মেলন সর্বোপরি আমাদের সমীপে জলবায়ু অর্থায়নে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত করতে সক্ষম হবে।

জারিন তাসনিম ঐশী একজন ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলার। বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ -এ সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত আছেন। ওয়াইপিএফে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ টিমে অ্যাভোকেসি লিড হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান (ন্যাপ) এবং ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন্স তৈরিতে যুক্ত ছিলেন।

রুবাইয়াত সানজিনা রানিলা ইয়ুথ পলিসি ফোরাম (ওয়াইপিএফ)-এর বাংলা এডিটোরিয়াল ও কনটেন্ট টিমে অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর লোক প্রশাসন বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন।

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কৃষককে কুপিয়ে জখম, আটক ২

ঢাকায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস 

ওমরাহ পালনে ইচ্ছুকদের জন্য বিশেষ সেবা চালু

সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, মরদেহ মিলল প্রতিবেশীর পরিত্যক্ত টয়লেটে

সুয়ারেজের দুই পেনাল্টিতে মেসিবিহীন মায়ামির রোমাঞ্চকর জয়

গাজায় নতুন ধাপে ‘গণহত্যা’ শুরু করল ইসরায়েলের সেনাবাহিনী

ডিমলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স  / ওষুধ-চিকিৎসকের সংকটে ভোগান্তিতে রোগীরা

পাকিস্তানের হুমকির পর ‘অগ্নি ৫’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ভারত

সরকারি সফরে চীন গেলেন সেনাপ্রধান 

সাগরে ভাসমান ১৩ জেলে উদ্ধার, নিখোঁজ ৬

১০

হবিগঞ্জে সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে ভয়াবহ আগুন

১১

অ্যাপলের আগে সারপ্রাইজ ‍দিল গুগল

১২

ভয়াবহ আগুনে তুলার মিল পুড়ে ছাই

১৩

২১ আগস্ট : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৪

দুপুরের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৫

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকার উল্টে নিহত ৩

১৬

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৭

২১ আগস্ট : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৮

৪ দিনের সফরে ঢাকায় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী

১৯

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাড়ল বাস ভাড়া

২০
X