ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এক ফিলিস্তিনি পরিবার। বিধ্বস্ত এক শহরের ভেতর দিয়ে হুসেইন শিবলি শুক্রবারের জুমার নামাজের পর বাসায় পৌঁছালেন। বাসার কাছে যেতেই দেখা গেল, বুলডোজার দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া একটা গাড়ি ওঠানো হচ্ছে। অদূরে পানির ট্যাঙ্কের গায়ের গুলির ছিদ্র মেরামত করছে একদল লোক। দমকল বাহিনী ব্যস্ত রাস্তা থেকে বিস্ফোরণে সৃষ্টি হওয়া ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে।
একান্নবর্তী পরিবারের আবাসস্থলে পৌঁছে শিবলি সিঁড়ি দিয়ে বসার ঘরের দিকে গেলেন। কাঁধে বসিয়ে নিক্ষেপ করা মিসাইলের আঘাতে জায়গাটা একটা পোড়া গুহার মতো হয়ে আছে। পুড়ে কালো হওয়া চেয়ারের কঙ্কালের ভেতরে দাঁড়িয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘এখানে কি বাস করা যায়? আমাদের সাথে কেন এমন ঘটল?’
শিবলি এবং তার পরিবার জেনিনে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় হামলার পর এখন নিজেদের সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দুই দিনের অভিযানে চালানো বিমান হামলা ও সশস্ত্র গোলাগুলিতে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার বাড়িগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ হামলায় অন্তত ১২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, তারা সবাই সন্ত্রাসী। তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অন্তত ৫০টি হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে জেনিনে অভিযানের জায়গাটি থেকে। এটি সন্ত্রাসীদের একটি বড় ঘাঁটি।
তবে আসল ঘটনা অন্যরকম। ৪৪ ঘণ্টাব্যাপী চলা সামরিক অভিযানের ভেতর যে পরিবারগুলো ছিল তাদের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। হাজারো মানুষ পালাতে সক্ষম হলেও, অনেকেই বাসাবাড়িতে আটকা পড়েন। তাদের বেশিরভাগই বাসার বাথরুম বা রান্নাঘরে আশ্রয় নেন। কেউ কেউ শিবলিদের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হন অর্থাৎ যাদের পুরো পরিবারকে বেজমেন্টে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
ছবি : মিসাইলের আঘাতে লন্ডভণ্ড বসার ঘরে হুসেইন শিবলি।
৬৯ বছর বয়সী হুসেইন শিবলি রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত টিভি দেখছিলেন। তিনি অবসর গ্রহণের আগে ইসরায়েলি একটি মাংস প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তার জন্ম জেনিনের ক্যাম্পে, যেখানে ১৪ হাজার মানুষ থাকেন। প্রায় অর্ধ বর্গকিলোমিটার জায়গায় এই বিরাট বসতি গড়ে উঠেছে। রাত ১টার দিকে ইসরায়েলি চ্যানেলে তিনি একটি সংবাদে দেখলেন- আইডিএফ সৈন্যরা ক্যাম্পে ঢুকেছে। এরপর তিনি নিজ এলাকায় শত শত ড্রোনের শব্দ শুনলেন। তিনি ভাবলেন, হয়তো বোমা ফেলা হবে। এরপরই বোমার শব্দও পাওয়া গেল।
একত্রে সংযোজিত তিনটি ভবনের ৯টি অ্যাপার্টমেন্টে শিবলিদের পুরো পরিবারের বসবাস। একটি ভবনে শিবলি এবং বাকি দুটিতে অন্য দুই ভাই থাকেন। তারা সবাই ইসরায়েলি রেইড সম্পর্কে আগে থেকেই জানেন। অভিযান শুরুর মিনিটের মধ্যে একান্নবর্তী এই পরিবারের সবাই বেজমেন্টে চলে গিয়েছিলেন।
ছবি : একটি বাসার বেজমেন্টেও চলে হামলা। সেখানে বালুর বস্তা দিয়ে গুলি ও মিসাইল আটকানোর চেষ্টা করা হয়।
হুসেইনের ভাতিজা ফাদি যে জায়গাটিতে টিয়াপাখি পালন করেন, রাতের অন্ধকারে সেই ছোট্ট জায়গাটিতেই পরিবারের প্রায় ৫০ জন আশ্রয় নেন। গুলির শব্দে পাখিগুলো চিৎকার করে উঠছিল। রোববার সারারাত এবং সোমবার দিনজুড়ে অভিযান চলার সময় তারা সেখানেই অবস্থান করেন। এ সময় তারা মোমবাতি জ্বালান। হুসেইন বলেন, ‘শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল।’
এ সময় ৩৪ বছর বয়সী ফাদি বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তার গর্ভবতী স্ত্রী এবং তিন বছরের শিশুসন্তান খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাদের নিয়ে তিনি ভবনের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় নেন। পুরোটা সময় ফাদি বাথরুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
শিবলিদের বাসাটি একটু উঁচুতে হওয়ায় তারা নিচে ইসরায়েলি সৈন্যদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারছিলেন। এ ছাড়া, প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের ফোন করে সৈন্যদের অবস্থান সম্পর্কে জানান। ফাদির পরিষ্কার মনে পড়ে সেই ফোনকলগুলোর কথা, ‘এখন তারা জাফরদের বাসায় যাচ্ছে’, ‘এখন তারা তোমার চাচাতো ভাইদের বাসায় যাচ্ছে।’
ছবি : শিবলিদের বাসার ছাদ থেকে জেনিন শহরকে অনেকটা এমন দেখায়-
সোমবার রাত ১১টার দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কলে শোনা যায়, ‘ফাদি ওরা এখন তোমাদের বাসার দিকে আসছে।’
এরপরই প্রায় ১২ জন সুসজ্জিত সশস্ত্র সৈন্য বাসার দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। ফাদি এ সময় তার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে কাঁদছিলেন। এ সময় তিনি বলে ওঠেন, ‘আস্তে! আস্তে! এখানে একটি শিশু আছে।’ সৈন্যদের নেতা আরবিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার আইডি কার্ড দেখাও।’
সে আবারও জিজ্ঞাসা করল, ‘সন্ত্রাসীরা কোথায়?’
এ সময় সৈন্যরা মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলল, ফাদিকে প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল এবং তাদের বসার ঘরে যেতে বলল। এ সময় সৈন্যরা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে। এক সৈন্য রান্নাঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে গুলি শুরু করে। ফাদি চিৎকার করে বলে ওঠে,‘বাচ্চাটা ভয় পাচ্ছে!’ বেজমেন্টে আশ্রয় নেওয়া ফাদির বাকি পরিবারের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছিল। নারীরা কাঁদছিল আর চিৎকার করছিল।
ছবি : বসার ঘরে ফাদি-
একপর্যায়ে ফাদির স্ত্রী সৈন্যদের কাছে সন্তানের জন্য একটি খেলনা আনার অনুমতি চান। সৈন্যরা ফাদিকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক খেলনা গাড়ি ছিল। তবে দরজার কাছে একটি খেলনা মেশিনগানও ছিল। এটা দেখার পরেই ফাদিকে সৈন্যরা বন্দুকের পেছনের অংশ দিয়ে আঘাত করে। ফাদি এরপর বেজমেন্টে পরিবারের সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করলে কমান্ডার তাকে নিষেধ করেন। সৈন্যরা এ সময় জানায়, তারা দ্রুতই বের হয়ে যাবে।
মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়ে লাউডস্পিকারে ঘোষণা আসল, ‘বের হয়ে যান, বের হয়ে যান। সবাই এখন নিরাপদ।’
এরপর বেজমেন্ট থেকে ধীরে ধীরে পুরো পরিবার বেরিয়ে আসে। বাইরে রেডক্রিসেন্টের দল এবং ফাদির পরিবারকে পাওয়া যায়। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিলেন। এ সময় এক দমকলকর্মী বলেন, ‘পুরুষরা নারী ও শিশুদের ভেতর দিয়ে হাঁটলে ভালো হবে, তাহলে তাদের গুলি করা হবে না।’ রাস্তাগুলো জমি চাষ দেওয়ার মতো করে ধ্বংস করে ইসরায়েলি বাহিনীরা। দীর্ঘক্ষণ আবদ্ধ থাকার পর ধ্বংসস্তূপ, কাঁটাতারের ভেতর দিয়ে নারী-পুরুষরা তাদের আত্মীয়স্বজনদের বাসায় ছড়িয়ে পড়ে।
ছবি : অভিযানের পর জেনিনের অলিগলির চিত্র-
হুসেইন বলেন, তাদের এলাকায় এমন অভিযানের কোনো মানেই নেই। তাদের পরিবারের কেউই সন্ত্রাসী কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। কেউই এমন নেই যে, ইসরায়েলিদের দ্বারা চিহ্নিত অপরাধী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার ইসরায়েলে কাজ করার অনুমতি রয়েছে।’ এ সময় হুসেইন ইহুদিদের সঙ্গে মিলেমিশে কীভাবে কাজ করেছেন সেই স্মৃতিচারণাও করেন।
শুক্রবার নাগাদ ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে থাকে। ধীরে ধীরে পুরো এলাকায় জীবন ফিরে আসতে শুরু করে। হুসেইনের বাসায় নারীরা রান্না করে। হুসেইনও পুনরায় টিভির সামনে গিয়ে বসেন। ফাদি তার পাখিদের দেখভাল শুরু করেন। অভিযানের কারণে ফাদির ২০টিরও বেশি পাখি মারা গেছে বলে জানান তিনি।
ছবি : বেজমেন্ট থেকে বের হওয়ার পর, খাবারের টেবিলে হুসেইন শিবলি পরিবারের সদস্যরা-
জাতিসংঘ সম্প্রতি জেনিনকে পুনরায় গড়ে তোলার জন্য দাতা দেশগুলোর কাছে সাহায্য চেয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ১৫ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য দেবে বলে জানিয়েছে। তবে এসব নিয়ে হুসেইন সন্দিহান। ‘আমরা সংবাদে টাকার কথা শুনি। কিন্তু জীবনেও চোখে দেখিনি।’ তার আশঙ্কা, জেনিন গরিবই থাকবে এবং ইসরায়েলি সৈন্যরা আবারও ফেরত আসবে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলিরা বলেছিল তারা জেনিনের প্রতিরোধকে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু তারা এটা করবে না।’
মূল লেখা : স্টিভ হেনরিক্স, ওয়াশিংটন পোস্টের জেরুজালেম ব্যুরো প্রধান ও সুফিয়ান তাহা, বিশেষ প্রতিনিধি, ওয়াশিংটন পোস্ট ।
ভাষান্তর : সরকার জারিফ ।
মন্তব্য করুন