কৌশিক বসু
প্রকাশ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:০৭ পিএম
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৩৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
কৌশিক বসুর নিবন্ধ

আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি

Accordion-tax
‘অ্যাকর্ডিয়ন ট্যাক্স’: ধনীদের সম্পদের ট্যাক্স পাবে দরিদ্ররা। ছবি : সংগৃহীত

একশ বছর আগের চেয়ে আজ পৃথিবীতে সম্পদের প্রাচুর্যতা বেড়েছে বহুগুণ। বেড়েছে মানুষের ভোগের পরিমাণও। সে সঙ্গে বেড়েছে ধনী এবং দরিদ্রের আয়বৈষম্য। একাবিংশ শতাব্দীতে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের কাজকে অনেক কমিয়ে দিয়েছে। লাখ লাখ কর্মী চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলার উপায় খুঁজে ফিরছেন অর্থনীতিবিদরা।

অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস তার ‘ইকোনমিকস পসিবিলিটিস ফর আওয়ার গ্রান্ড চিলড্রেন’ প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩০ সালে। সেখানে তিনি অবসর এবং প্রাচুর্যে ভরা একটি ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। তার সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজ আলোচনার সময় এসেছে।

কেইনস মূলত ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারের একটি স্কুলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তার প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। এটিকে সংশোধন করে দুই বছর পর নিবন্ধ আকারে প্রকাশ করেন। নিবন্ধটির মূল বক্তব্য ছিল একশ বছর পরের পৃথিবীর অর্থনীতি কেমন হবে। সেখানে তিনি দেখান- তৎকালীন সময় থেকে একশ বছর পরের পৃথিবীতে সম্পদের প্রাচুর্যতা বাড়বে কয়েকগুণ। একই সঙ্গে মানুষের জীবযাত্রার মান ৪ থেকে ৮ গুণ বৃদ্ধি পাবে।

কেইনস ছিলেন অত্যন্ত প্রজ্ঞার অধিকারী এবং দূরদর্শী একজন চিন্তক। তিনি পরবর্তী পাঁচ বা দশ বছর পরের ভবিষ্যদ্বাণীর পরিবর্তে আগামী শতাব্দীর দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি পর্যবেক্ষণ করেন, সমাজ একটি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ে উঠছে। আর সেই রোগটি হলো প্রযুক্তি। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমের চাহিদা হ্রাস করেছে। তবে তিনি এই ‘প্রযুক্তিগত বেকারত্ব’-কে আশাবাদী দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে এবং অবসর যুগের সূচনা করবে। কেইনসের সেই ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তবে তিনি যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তার সবটা সমানভাবে ঘটেনি। কেইনস বলেছিলেন, আগামী একশ বছরের মধ্যে মানুষের কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনেকটা ফুরিয়ে যাবে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে পণ্যগুলো উৎপাদন করা জরুরি সেগুলোর জন্য আর কাজ করার প্রয়োজন হবে না। তিনি বলেছিলেন, দরিদ্র এবং ধনী উভয়শ্রেণির মানুষ এমন সমৃদ্ধি উপভোগ করবে যে শ্রম অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।

‘দরিদ্র এবং ধনী উভয় শ্রেণির মানুষ সমৃদ্ধি উপভোগ করবে’- কেইনস এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তার আদর্শের কারণে। তার এই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হওয়ার প্রধান কারণ, তিনি নিজের নৈতিকতাগুলো তার ভবিষ্যৎবাণীতে তুলে ধরেন। সম্পদের প্রতি মানুষের লোভকে কেইনস ঘৃণার চোখে দেখতেন। শুধু নিজের স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াকে তিনি ‘জঘন্য অসুস্থতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সম্পদ প্রাপ্তির চাহিদা এবং সম্পদের প্রতি মানুষের লোভ চিরন্তন। কেইনসের ভুল ছিল, তিনি মানুষের এই চাহিদাকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার আর্থিক নিরাপত্তা অধিকাংশ মানুষকে সন্তুষ্ট করবে। তিনি আরও ন্যায়সঙ্গত একটি বিশ্ব কল্পনা করেছিলেন যেখানে মানুষ অর্থনৈতিক উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাবে এবং অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি উপভোগ করতে পারবে। অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিটজ এই প্রসঙ্গে বলেন, কেইনস মানুষের অবসরের আকাঙ্ক্ষা এবং মানুষের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্যকে ভুলভাবে বিবেচনা করেছিলেন। যেমন- একজন মানুষ যখন তার বাড়ির প্রতিটি বেডরুমে এমনকি তার ব্যবহৃত গাড়িতে একটি করে ভিডিও স্ক্রিন রাখতে পারছে তখন তিনি বাড়িতে একটি টেলিভিশন রেখে তুষ্ট হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

অর্থনীতিবিদ এলিজাবেথ কলবার্ট দ্য নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, একশ বছর আগের থেকে এখন উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বেড়েছে কিন্তু তাতে মানুষের কাজ কমেনি। দরিদ্র শ্রেণির মানুষই এখন তুলনামূলকভাবে কম কাজ করে কারণ এখন জীবনের অনিশ্চয়তা কম। প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে মানুষের বেঁচে থাকা এখন অনেক সহজ হয়েছে। ধনী শ্রেণির মানুষ নিজেদের এখন আগের চেয়ে বেশি কাজের মধ্যে রাখেন কারণ, তাদের মধ্যে সম্পদ নিয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব রয়েছে।

দেশ এবং অঞ্চলভেদেও কাজের পরিমাণ এবং অবসরের অনুপাতে তারতম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকানরা ব্রিটিশ শ্রমিকের তুলনায় বার্ষিক ১০০ ঘণ্টা বেশি কাজ করেন এবং ফরাসি শ্রমিকের তুলনায় এটি ৩০০ ঘণ্টা বেশি। মার্কিন কর্মীরা তাদের ইউরোপীয় সমকক্ষদের তুলনায় কম ছুটি ভোগ করে। আইনত, প্রতি বছর তারা কমপক্ষে চার সপ্তাহের বৈতনিক ছুটির অধিকারী।

কেইনস সম্পদের প্রতি মানুষের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে মূল্যায়ন করেননি। মানুষ সম্পদ অর্জন করতে চায় শুধু তার বেঁচে থাকার চাহিদা পূরণের জন্য নয়। সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্যও মানুষ সম্পদ বাড়াতে চান। বিশেষ করে ধনীরা সমাজে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান বজায় রাখাতে চান। ফলে আধিপত্যের জন্য এক অন্তহীন প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। কেইনস বিশ্বাস করতেন, স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী একটি ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে। তবে এটি আজ স্পষ্ট, একটি বিপ্লব ছাড়া কোনো দেশে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

কেইনস যে ন্যায়সঙ্গত সমাজ কল্পনা করেছিলেন সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হল ধনীদের থেকে ট্যাক্স নেওয়া। আমার সাম্প্রতিক বই ‘রিজন টু বি হ্যাপি’-তে আমি একটি কর ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছি যা ধনী থেকে দরিদ্রদের মধ্যে পুনঃবণ্টন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই ডিজাইনে ধনীদের আপেক্ষিক অবস্থানগুলোও অপরিবর্তিত থাকবে। এই ব্যবস্থাকে আমি ‘অ্যাকর্ডিয়ন ট্যাক্স’ হিসেবে অভিহিত করেছি। এই প্রস্তাবে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ধনীরা তাদের গড় আয়ের ওপর কর প্রদান করবেন এবং সেই অর্থ কীভাবে নিম্ন মজুরির মানুষের মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় আয় বৈষম্য কমানো সম্ভব হবে।

এই পদ্ধতিটি ইলন মাস্ক এবং জেফ বেজোসের মতো বিলিয়নিয়াররা কর-পরবর্তী আয় যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস করেও তাদের আপেক্ষিক অবস্থান বজায় রাখবে। বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের র‌্যাকিংই তাদের প্রাধান উদ্বেগ। এ ছাড়া এই বিপুল সম্পদের কোনো প্রয়োজনীয়তা তাদের নেই। ‘অ্যাকর্ডিয়ন ট্যাক্স’ প্রক্রিয়া ধনীদের র‌্যাংঙ্কিংয়ে কোনো প্রভাব ফেলবে না এবং তাদের উদ্ভাবন ও নতুন উদ্যোগ নেওয়ার প্রেরণাকে নষ্ট করবে না। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের পরিবারের অর্থনৈতিক কল্যাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

বিশ্বের বেশ কিছু বিলিয়নেয়ারসহ বহু মানুষ আজ এই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের স্বার্থেই এমনটা চিন্তা করছেন। তবুও আশার বাণী রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের রাস্তা অত্যন্ত দীর্ঘ তবে আমরা এই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হচ্ছি। আমরা একটি ন্যায়সঙ্গত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। (স্বস্ত: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৪)

কৌশিক বসু : বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ; ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিপুনের পেছনে বড় কোনো শক্তি আছে : ডিপজল

ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে চবিতে সাইক্লিস্টের র‍্যালি

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আইআইইউসি প্রতিনিধিদলের সৌজন্য সাক্ষাৎ

আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগ

রাইসির মরদেহ কোথায়, জানাজার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত?

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ৫০ বছরের পুরোনো

মসজিদে ডুকে ইমামকে যুবদল নেতার বেধড়ক মারধর

রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের পরও বেঁচে ছিলেন এক আরোহী

ছেলের আত্মহত্যায় মায়ের বিষপান

অপু বিশ্বাসের অভিযোগে ৩ জনকে সতর্ক করল পুলিশ

১০

চট্টগ্রামে সোর্সের তথ্যে বেপরোয়া পুলিশ!

১১

মেয়রের সামনে কাউন্সিলর রতনকে জুতাপেটা করলেন চামেলী

১২

স্ত্রীর মরদেহ বিছানায়, ফ্যানে ঝুলছিলেন স্বামী

১৩

বদলির প্রায় দুই বছরেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত তিনি

১৪

শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে টেনিস বল গ্রাউন্ড নির্মাণকাজে অনিয়ম

১৫

বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের আহ্বান মহিলা ঐক্য পরিষদের 

১৬

স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের সম্মেলন শুক্রবার

১৭

ইঞ্জিনিয়ার পরিচয়ে বিয়ে, ডিভোর্স দিয়ে স্ত্রীর অন্তরঙ্গ ভিডিও ফেসবুকে

১৮

বিএনপির হারানোর কিছু নেই : আমিনুল হক

১৯

টেকনাফে অপহরণ চক্রের প্রধান মোর্শেদ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার

২০
X