কৌশিক বসু
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
কৌশিক বসু

কোন পথে ভারত?

কোন পথে ভারত? ছবি : সৌজন্য
কোন পথে ভারত? ছবি : সৌজন্য

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে বাজার। বাজারের হট্টগোল এবং কোলাহলের মধ্যেও একধরনের জীবনমানের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, মানবসমাজ গড়ে উঠেছে বাজারকে কেন্দ্র করে। বাজারে ক্রেতা বিক্রেতার আদান-প্রদান, ঝগড়া এবং বন্ধুত্ব সবকিছুই সমাজ গঠনের সঙ্গে যুক্ত।

নৃবিজ্ঞানীরা প্রাচীন কোনো সভ্যতা বা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বোঝার জন্য সবার আগে সেখানকার বাজারব্যবস্থা কেমন ছিল, তা দেখার চেষ্টা করেন। আধুনিক ভারত এবং এর পটভূমি সম্পর্কে গবেষণা করতেও এটা একটি ভালো উপাদান।

গত সপ্তাহে দিল্লির বিভিন্ন বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়েছি আমি। কথা বলেছি বন্ধুভাবাপন্ন দোকানদার এবং ফুটপাতের ধারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও। ভারতের ঐতিহ্যবাহী উষ্ণ আভার অনুভূতি নিয়েছি এবং আনন্দ করেছি। তারপর এ দেশের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

এটি এমন একটি জায়গা যেখানে কেউ প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে বা রাস্তা বলে দিতে মোবাইল ফোনের দিকে তাকায় না। আপনি সেখানে যার কারো কাছেই প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য জিজ্ঞাসা করুন, দেখবেন বেশকিছু স্থানীয় ছুটে এসেছে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য।

আমি একটি ছবি তোলার দোকানের খোঁজ করছিলাম। তখন আমার অভিজ্ঞতাটা ছিল এ রকম, ছেঁড়া পোস্টার এবং পলেস্টার খসে পড়া সারিবদ্ধ বিল্ডিয়ের মধ্যে একটি সরু গলি। তার মধ্যে রাউল ডুফি স্কেচের মতো একটি ফটো স্টুডিও।

যখন আমি দরজা দিয়ে ভেতরে পা রাখলাম, দোকানের মালিক এবং তার দুজন সহকারী সুরেলা বৈদিক গান শুনছিলেন। আমাকে দেখে দোকানের মালিক চওড়া হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি একটি ‘সুন্দর’ ছবি তুলতে চাই কি না। আমি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারার আগেই তার সহকারীরা স্টুডিও প্রস্তুত করা শুরু করল। তারা ক্যামেরা সেটআপ করল, আলোর ব্যবস্থা করল, আমার পেছনের পর্দা ঠিক করল এবং আমার চিবুকের কাছে স্পর্শ করে মাথা কাত করে নিল যাতে ভালো ফ্রেম পাওয়া যায় এবং ছবিটি সুন্দর আসে।

কয়েকবার ক্যামেরা ক্লিক করার পর, ফলাফল যাচাই-বাছাই করতে জড়ো হল তিনজন। তারা আমার মুখ এবং ছবির দিকে বারবার তাকিয়ে যাচাই করার চেষ্টা করল ছবিটি ঠিকঠাক হয়েছে কি না। সহকারীদের মধ্য থেকে একজন বলল, ছবিটি আরও একটু ভালো হতে পারত। অন্য সহকারী পরামর্শ দিল- আমার মাথায় আরও বেশি চুল যুক্ত করে দিলে ছবি আরও ভালো দেখাবে।

দোকানের মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনি কি নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের স্কাইলাইনের কোনো দৃশ্য আপনার ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড যোগ করতে চান?’ আমি তাদের হতাশ করে দিয়ে বললাম, যদি আমি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে আমার মাথাভর্তি নকল চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছবি তাদের হাতে দিই তাহলে পাসপোর্ট অফিস আমাকে আটকে দেবে। আমি একটি হেডশট ছবি তৈরি করে দিতে বললাম তাদের।

এটি ছিল খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের একটি ঘটনা। কিন্তু এটি আমাকে সে সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যখন আমি ভারতে থাকতাম এবং ভারতেই কাজ করতাম। সেই ফটো স্টুডিওতে থাকা সময়টি যদি শেষ না হতো! আমি সেখানে আমার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে করছিলাম।

ভারত একটি নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ। বেশকিছু ক্ষেত্রে ভারতের অর্থনীতি ভালো পারফর্ম করেছে। ২০২২-২৩ সালে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ভারত একটি বৃহৎ উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ককে পুঁজি করে এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র যতটা রঙিন মনে হচ্ছে সত্যিকারের চিত্র ততটা রঙিন নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি একটি সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। করোনা মহামারি এবং লকডাউনের ফলে সে বছর ৭ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে ভারতের জিডিপি। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ও অকার্যকর অর্থনীতির মধ্যে একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে ভারত। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশেরও কম। এটি চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ, এমনটা নয়। তবে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান, স্লোগান এবং প্রতিবেদনগুলোর চেয়ে তা অনেক কম চিত্তাকর্ষক।

তার ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফলের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে ধনীদের কাছে। তরুণরা যথাযথ মজুরি চেয়ে সংগ্রাম করছে এবং যুব বেকারত্বের হার গত বছর ২৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে এই বেকারত্বের হার ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১২০টির চেয়েও খারাপ। শিল্প খাতে চাকরি হারিয়ে কৃষি খাতে চলে যাচ্ছে অনেক কর্মশক্তি। ছোট ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। উচ্চ খাদ্য-মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তকে আরও চেপে ধরেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এসব কিছু ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিচ্ছে।

তবে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হল রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি। গণতন্ত্রের অবক্ষয়, ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উত্থান এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই নির্দেশকগুলো স্বাধীন ভারতের আদি মূল্যবোধ ও নীতিকে অস্বীকার করে, যে মূল্যবোধ ও নীতির জন্য ভারত বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছিল। যদিও দেশটি কয়েক বছর ধরে তার নীতি ও আদর্শ থেকে পিছলে গিয়েছিল, তবে এর অন্তর্ভুক্তি এবং গণতন্ত্র এখনও চলমান।

ক্রোনিজমের উত্থান একটি দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে। যেসব দেশে এটি ব্যাপকভাবে ঘটেছে সেখানে অর্থনৈতিক নীতি শুধু ধনীদের স্বার্থেই নেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বড় বড় চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রেও দেশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, অপরপক্ষ জানে এখানে শুধু ধনিকশ্রেণী এবং কয়েকজন নেতাকে খুশি করলেই কাজ পাওয়া যাবে। সমাজের বাকি অংশের জন্য একটি চুক্তি ভালো নাকি ক্ষতিকর তা অপ্রাসঙ্গিক।

আর এর সঙ্গে যদি ধর্মীয় বৈষম্য যুক্ত হয় তবে সেই পতন আরও ত্বরান্বিত হয়। ২০০৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ক্রোনিজম এবং ধর্মীয় মৌলবাদের সংমিশ্রণ পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং এ সময় দ্রুত এগিয়ে যায় ভারত।

বাজার এবং বাজারের বাইরেও অস্বস্তির অনুভূতি স্পষ্ট। কিন্তু বাজারের বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এমনকি সরকারি আমলাসহ বিভিন্ন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথোপকথনে এ উপলব্ধি আমার হয়েছে যে– দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কাররোধে আরও সচেতন হতে হবে। ভারতের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর।

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: মুজাহিদুল ইসলাম

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাশিয়ার ‘শ্যাডো ফ্লিটে’ ক্ষেপেছে যুক্তরাজ্য

৩০ ভারতীয় কামিকাজে ড্রোন ভূপাতিত, নিহত ২

বোমা আতঙ্কে কাঁপছিলেন আইপিএল চিয়ারলিডার, ভিডিও ভাইরাল

ছুটির দিনেও ঢাকার বাতাস ‘অস্বাস্থ্যকর’ 

ভয়ে ভারত ছাড়তে চাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটাররা

পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো পিএসএল

আইভীকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ

যমুনার সামনে তৈরি হচ্ছে আ.লীগ নিষিদ্ধের মঞ্চ

বিমানে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে ট্রাম্প প্রশাসন

পারভেজ হত্যায় গ্রেপ্তার টিনা, ৫ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ

১০

আইভীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের গাড়িবহরে হামলা

১১

ভারতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা, অস্বীকার পাকিস্তানের

১২

পাকিস্তানে আরেকটি ভারতীয় ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত

১৩

‘৯ মাসেও গণহত্যাকারী দল নিষিদ্ধ হলো না কেন’

১৪

বাদ জুমা বড় জমায়েতের ডাক হাসনাত আবদুল্লাহর

১৫

এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা / নিহত ৪ জনের দুজন ছিলেন মসজিদের ইমাম

১৬

রাতে শিবির মাঠে নামায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট

১৭

যমুনার সামনে রাতভর যা যা হলো

১৮

কয়টি রাফায়েল আছে ভারতের, একেকটির দাম কত?

১৯

ফের গোলাগুলি শুরু, উত্তেজনা তুঙ্গে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে

২০
X