মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
ড. কামরুল হাসান মামুন
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

কেউ ডুবন্ত তরীতে উঠলে সে নিজেও ডুবে অন্যকেও ডুবায়

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোগো। গ্রাফিক্স : কালবেলা
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোগো। গ্রাফিক্স : কালবেলা

দুই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত হলো ৯ সরকারি কলেজ। আমরা যদি সভ্য হতাম তাহলে কী করতাম? তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার বড় বড় ৭টি সরকারি কলেজকে যুক্ত করার ফলে এই ৭ কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার কতটা উন্নতি হয়েছে তার একটা বিশদ গবেষণা করে দেখতাম।

এমন কোনো গবেষণা কী হয়েছে যে এতে ৭ কলেজের কতটা উন্নতি হয়েছে। কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার কী আদৌ কোনো উন্নতি কিংবা অবনতি হয়েছে কি না।

আমাদের হুটহাট করে কোনো কিছু করার অভ্যাস এখনও গেল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭টি কলেজ নেওয়ার সিদ্ধান্তের আগে অনেক আলোচনা এবং অনেক পর্যালোচনার দরকার ছিল। সভ্য দেশ এমনই করে। কিন্তু আমাদের উঁচু মহলে কেউ একটা স্বপ্ন দেখলে হীরক রাজার দেশের মতো করে বাস্তবায়নে লেগে পরে। আমাদের আগে অনার্স ৩ বছরের আর মাস্টার্স এক বছরের ছিল। হঠাৎ ক্ষমতাবান কেউ একজন বলল এখন থেকে ৪ বছরের অনার্স করতে হবে। ব্যাস। হয়ে গেল।

এতে যে শিক্ষার্থীরা ১ বছর বেশি পড়বে তার জন্য আমাদের যথেষ্ট শিক্ষক আছে কি না, যথেষ্ট আবাসিক ব্যবস্থা আছে কি না কেউ কিছু ভাবল না। গণরুমের জন্ম ঠিক তখন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই তার ঘানি টানতে পারছিল না অথচ তার ওপর চাপিয়ে দিল তার চেয়ে ৩ কিংবা ৪ গুণ ভার। আমি আমার বিভাগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আমার শিক্ষকরা কী পরিমাণ ব্যস্ত থাকে ৭ কলেজ নিয়ে। এই ব্যস্ততার কিছুটা কেরানির মতো কাজ যেমন মিটিং করা, কে বা কারা প্রশ্ন করবে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর বাকিটা প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার ডিউটি করতে যাওয়া। কাউকে এক দিন কোনো একটি কলেজে যাওয়া মানে ওই দিন সেই শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ক্লাস বা অন্য কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। এতে নিজ বিভাগের ছাত্ররাও ওই শিক্ষকের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়। উন্নত বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করা হয়? তারা সর্বদা দেখে শিক্ষকদের মেধাকে কীভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। যেই কাজ একজন গ্রাজুয়েট দিয়ে করানো যায় সেটি একজন গ্রাজুয়েটকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বানিয়ে তাকে দিয়ে করানো হয়। এতে ওই গ্রাজুয়েট ল্যাবে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে আবার আর্থিক সুবিধাও পায়। আর এই কাজে একজন অধ্যাপক যেই সময়টা দিতেন সেটা গবেষণা বা শ্রেণিকক্ষে পড়ানোতে দিতে পারে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় তথা ছাত্ররা উপকৃত হয়। ভালো ভালো অধ্যাপকদের সময় বাঁচানোর জন্য পার্ট-টাইম শিক্ষক এবং অ্যাডজাংক্ট শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়। আর আমরা কী করছি নিজের বিভাগের বাইরে অন্য কলেজে যাওয়া আসায় সময় অপচয় করাচ্ছি, পরীক্ষার ডিউটিতে অপচয় করতে বাধ্য করছি। এমনিতেই আমাদের যথেষ্ট শিক্ষক নেই। সেই শিক্ষকদের যদি দৌড়ের ওপর রাখি তাহলে শিক্ষকদের চিন্তার জাবর কাটার সময় কোথায়?

গবেষণাতো এমন জিনিস না যে বলবেন এখন এই এক ঘণ্টা সময় দিলাম চিন্তা করে একটা আইডিয়া বের করেন তারপর সেটার ওপর কাজ করে জলদি কিছু গবেষণা করে আর্টিকেল প্রকাশ করুন। না। তা সম্ভব না। শিক্ষকদের প্রচুর ফ্রি সময় থাকতে হবে। সৃষ্টিশীল মানুষদের জাবর কাটার সময় না দিলে সৃষ্টিশীল কাজ হবে না। ফিজিক্যাল কাজ চাপিয়ে দিয়ে করানো গেলেও সৃষ্টিশীল কাজের জন্য প্রচুর ফ্রি টাইম দরকার ঠিক যেমন ব্রেইনের প্রচুর ফ্রি অ্যাবস্ট্রাক্ট স্পেস লাগে। আমরা ব্রেইনের নিউরনের যতটুকু সর্বোচ ব্যবহার করি আমাদের ঠিক ততগুলোই নিউরন থাকলে এখন আমাদের ব্রেইন যতটা কাজ করে তার মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগও করতে পারত না। ব্রেইনের জন্য প্রচুর ফ্রি স্পেস লাগে আর সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য প্রচুর ফ্রি সময় লাগে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এটাই বোঝে না। অনেক সময় বলে ও সারা দিনে মাত্র একটা ক্লাস? ৮ জন ছাত্রকে যে সুপারভাইস করছি ওইটা দেখেন না? রাতদিন ওদের সঙ্গে ফোন, জুম্ ও মেসেঞ্জারে আলোচনা করছি ওটা দেখেন না, রাতদিন বসে আর্টিকেল লিখছি ওইটা দেখেন না? ফ্রি টাইম দেখেই মাথায় পাগ ওঠে আর সেই সময়টাকে যেন কাজে লাগাই তার জন্যই এই ব্যবস্থা তাই না? তাতেও যদি দেশের এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ হতো আপত্তি থাকতো না। ওই ৭টা কলেজকে একটু উন্নত করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতটা ক্ষতি করলেন সেটাতো দেখছেন না।

এমনিতেই শিক্ষকদের বেতন কম হওয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম পড়ায়। তার ওপর ৭ কলেজ। তাহলে এইটাকে রেঙ্কিং-এ উপরে তুলবেন কীভাবে? একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমপ্যাক্ট আর ৭টা মোটামোটি ভালো কলেজ ও ১টি তথৈবচ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক না। সত্যিকারের ভালো মানের একটি প্রতিষ্ঠানের ইমপ্যাক্ট বলে শেষ করা যাবে না। ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মতো হতো এই একটিই যথেষ্ট ছিল বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাঁচার জন্য কেউ ডুবন্ত তরীতে উঠলে সেই তরী নিজেও ডুবে অন্যকেও ডুবায়।

ড. কামরুল হাসান মামুন : অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বছর ঘুরে ফিরল সেই জুলাই 

৩৬ জুলাই বিপ্লব ও নির্মম নির্যাতনের মধ্যেও বেঁচে ফেরার গল্প

৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ / এস আলম পরিবারের তিন সদস্যসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে দুই মামলা

খুবির দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনকে কটাক্ষের অভিযোগ

রাজশাহীতে ঐতিহাসিক ‘সান্তাল হুল’ দিবস উদযাপন

২৯৫ জন অস্থায়ী কর্মীকে স্থায়ী করল চসিক

যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেন ইউনূস-রুবিও

করোনার ‘ভুল রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণা’, অতঃপর...

ইরানে একাধিক ইউরোপীয় নাগরিক গ্রেপ্তার

ঢাবি শিক্ষার্থী সৌমিকের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

১০

ছাত্রদল কর্মীর নেতৃত্বে হাবিপ্রবিসাসের অফিসরুম ভাঙচুর

১১

গাজাবাসীর জন্য বিশেষ ভিসা চালু করতে স্টারমারকে ব্রিটিশ এমপিদের চিঠি

১২

পাবিপ্রবিতে শিক্ষাবৃত্তি ও গবেষণা প্রণোদনা প্রদান

১৩

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে নারীদের অবদান নিয়ে বিএনপির কমিটি

১৪

মেহেরপুরে পৃথক দুই মামলায় দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১৫

ডিএনএ বায়োল্যাব-এইচজিআরটিসির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই

১৬

এবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনালাপ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্তা

১৭

জবির স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় আয় ১২ কোটি টাকা  

১৮

সন্তানের কলেজ থেকে ফিরছিলেন দম্পতি, ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত

১৯

শ্রীলীলার পারিশ্রমিক বেড়ে দ্বিগুণ

২০
X