বর্তমান সময়ে ফেসবুক শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়- এটি হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী মতপ্রকাশ, ব্যবসা, সংবাদ এবং মানবিক সংযোগের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। এ বিশাল কমিউনিটিকে সুরক্ষিত ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্যই ফেসবুক গড়ে তুলেছে একটি কাঠামোবদ্ধ নীতিমালা— Community Standards.
গাইডলাইনের মূল উদ্দেশ্য :
ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মূলত ৪টি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত :
❖ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
❖ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা
❖ গোপনীয়তা ও মর্যাদা রক্ষা
❖ প্রতারণা ও ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ
এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে :
❖ শালীনতা ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা -
বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নগ্নতা, অশ্লীলতা, পর্নোগ্রাফি বা অতিরিক্ত খোলামেলা যৌন বিষয়ক কনটেন্ট সীমিত করা এবং সমাজের সার্বিক নৈতিকতা রক্ষায় ভূমিকা রাখা।
উদ্দেশ্য : বাংলাদেশের সামাজিক অনুভূতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সম্মান রেখে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ।
উদাহরণ : খোলামেলা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি, ভাষা বা ভিডিও শেয়ার করলে তা সরিয়ে ফেলা হবে বা অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই নীতিগুলোর মাধ্যমে ফেসবুক এমন একটি ভার্চুয়াল পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়, যেখানে ব্যবহারকারীরা মুক্তভাবে মতামত দিতে পারেন- তবে সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে।
নিষিদ্ধ কনটেন্টের বিস্তারিত ক্যাটাগরি :
১. সহিংসতা ও উগ্র আচরণ :
❖ হত্যার হুমকি, শারীরিক আঘাত, নির্যাতনের উসকানি।
❖ সন্ত্রাসী বা অপরাধী সংগঠনের প্রচার।
❖ আত্মহত্যা বা আত্ম-আঘাত সম্পর্কিত কনটেন্ট।
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ রক্ত বা রক্তাক্ত অবস্থার দৃশ্য।
✔️ সহিংসতা বা লাশের দৃশ্য।
✔️ প্রশাসনের বাহিনী ছাড়া অস্ত্র প্রদর্শন।
✔️ জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদ প্রচার।
✔️ হুমকি, স্লোগান বা উসকানি।
✔️ পোশাকধারী বাহিনী ছাড়া অস্ত্র প্রদর্শন।
২. ঘৃণাত্মক বক্তব্য :
❖ বর্ণবাদ, ধর্মবিদ্বেষ, লিঙ্গভিত্তিক ঘৃণা।
❖ এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী বক্তব্য।
❖ মর্যাদাহানিকর ভাষা বা চিত্র।
নোট : যা যা করা যাবে না
উদাহরণসহ বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো
● বর্ণবাদ
উদাহরণ : “ওরা তো পাহাড়ি মানুষ, বিশ্বাস করা যায় না, এরা সব সময় সমস্যা করে।” এই বক্তব্যটি বাংলাদেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণাপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক। এটি জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ায়।
● ধর্মবিদ্বেষ
উদাহরণ : ‘সব মুসলমানই সন্ত্রাসী, ওদের ফেসবুক থেকে বাদ দেওয়া উচিত।’
এটি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্বেষপূর্ণ এবং সহিংস ইঙ্গিত।
● লিঙ্গভিত্তিক ঘৃণা
উদাহরণ : ‘মেয়েরা তো মস্তিষ্কহীন- ওদের অফিসে নেওয়া মানেই সমস্যা ডেকে আনা।’ এটি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও হেয়প্রতিপন্ন করার স্পষ্ট উদাহরণ।
● এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী বক্তব্য
উদাহরণ : ‘বাংলাদেশে হিজড়াদের জায়গা নেই, এদের ফেসবুক আইডি ডিলিট করা উচিত।’
এই বক্তব্যটি এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠীকে (যেমন : হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ) লক্ষ্য করে ঘৃণা ছড়ায় এবং সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানায়। এটি কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে।
● মর্যাদাহানিকর ভাষা বা চিত্র
উদাহরণ: “বেদের তো কোনো শিক্ষার দরকার নেই, ওরা তো জাদুটোনা করেই চলে।” এই বক্তব্যটি একটি ঐতিহ্যবাহী পেশাজীবী সম্প্রদায়কে হেয় করে উপস্থাপন করছে। এটি সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যকে অপমান এবং ঘৃণা ছড়ানোর ইঙ্গিত বহন করে।
৩. হয়রানি ও অপমানজনক আচরণ
❖ ব্যক্তিগত আক্রমণ, বুলিং, অপমান।
❖ শারীরিক অবস্থা, অসুস্থতা বা অক্ষমতা নিয়ে কটাক্ষ।
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ কাউকে বারবার টার্গেট করে বাজে মন্তব্য।
✔️ শারীরিক দিক বা স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র বা ভিডিও।
৪. যৌনতা ও নগ্নতা :
❖ পর্নোগ্রাফি বা যৌন কনটেন্ট।
❖ শিশু যৌন নিপীড়ন বা সঙ্গী খোঁজার পোস্ট।
নোট : যা যা করা যাবে না।
✔️ নগ্নতা বা যৌন কার্যকলাপের দৃশ্য।
✔️ শিশুদের নগ্ন/অর্ধনগ্ন ছবি বা ভিডিও।
✔️ নারী, পুরুষ অথবা শিশু কারোরই উন্মুক্ত বক্ষ প্রদর্শন করে কোনো ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না।
৫. ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তি :
❖ স্বাস্থ্যবিষয়ক মিথ্যা তথ্য।
❖ নির্বাচনের ভুয়া ফলাফল বা গুজব।
❖ বিভ্রান্তিকর ডিপফেক ভিডিও।
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে ভুয়া চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচার করা যাবে না।
✔️ নির্বাচনসংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর তথ্য (যেমন : ভোটের তারিখ ভুল, জাল ভোটের অভিযোগ) ছড়ানো যাবে না।
✔️ deepfake ভিডিও ব্যবহার করে কাউকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা যাবে না।
✔️ ভুয়া নিউজ হেডলাইন বা সম্পাদিত ছবি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।
✔️ যাচাই না করা তথ্য ‘ফ্যাক্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
৬. স্প্যাম, স্ক্যাম ও ভুয়া কার্যক্রম :
❖ ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি, পরিচয় চুরি।
❖ স্ক্যাম লিঙ্ক, ফেক লটারির প্রতিশ্রুতি।
❖ অটোমেটেড মেসেজ বা কমেন্টের মাধ্যমে প্রচারণা।
নোট : যা যা করা যাবে না।
✔️ পরিচয় চুরি করে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না।
✔️ স্ক্যাম লিঙ্ক বা ভুয়া পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না।
✔️ বট বা সফটওয়্যার দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেসেজ/কমেন্ট করা যাবে না।
৭. কপিরাইট লঙ্ঘন :
❖ অনুমতি ছাড়া অন্যের ছবি, গান, ভিডিও ব্যবহার।
❖ কপিরাইট/ ট্রেডমার্ক লঙ্ঘন করে কনটেন্ট শেয়ার।
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ অনুমতি ছাড়া অন্যের তৈরি কনটেন্ট পোস্ট করা যাবে না।
✔️ অন্য প্রতিষ্ঠানের লোগো, স্লোগান বা ব্র্যান্ড ব্যবহার করা যাবে না।
✔️ সিনেমা, গান বা নাটকের কাটা অংশ প্রকাশ করা যাবে না।
৮. ভয়ংকর বা পীড়াদায়ক কনটেন্ট :
❖ এমন ছবি বা ভিডিও যা দেখে মৃত মনে হয় এবং পুরোপুরি ঢেকে রাখা হয়নি।
❖ শিশুকে মারধরের দৃশ্য, সরাসরি আত্মহত্যার দৃশ্য।
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ মৃতদেহ, মৃত মনে হয় এমন কোনো মানুষ দেখানো যাবে না।
✔️ পচে/গলে যাওয়া প্রাণীর দৃশ্য দেখানো যাবে না।
✔️ হিংস্র আঘাতের ভিডিও দেওয়া যাবে না।
✔️ শিশু নির্যাতনের দৃশ্য বা শব্দ, আত্মহত্যার দৃশ্য শেয়ার করা যাবে না।
৯. স্বাস্থ্য ও নির্বাচন সংক্রান্ত ভুল তথ্য :
❖ ১০০% নিশ্চিত না হয়ে স্বাস্থ্য বা নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্য প্রচার
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ চিকিৎসা বা ওষুধ সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানো যাবে না
✔️ টিকা বা নির্বাচন নিয়ে গুজব ছড়ানো যাবে না
✔️ ভোট গণনা বা ফলাফল নিয়ে মিথ্যা দাবি করা যাবে না
১০. ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার :
❖ ফোন নম্বর, ইমেইল, এনআইডি, পাসপোর্ট নম্বর, রোল বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রকাশ
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য ( মোবাইল, ঠিকানা, পরিচয়পত্র) প্রকাশ করা যাবে না, ব্লার করে দিতে হবে।
✔️ ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট বা স্ক্রিনশট অনুমতি ছাড়া শেয়ার করা যাবে না প্রয়োজনে ব্লার করে দিতে হবে।
১১. প্রাণী নির্যাতন :
❖ প্রাণীর প্রতি নির্যাতনের ছবি বা ভিডিও
নোট : যা যা করা যাবে না
✔️ প্রাণীকে মারধর, কষ্ট দেওয়া বা হত্যার দৃশ্য প্রচার করা যাবে না
✔️ প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুর আচরণের ভিডিও বা লাইভ স্ট্রিমিং করা যাবে না
রিপোর্টিং পদ্ধতি :
ফেসবুকে কোনো কনটেন্ট নিয়ম ভাঙছে কি না, তা ৩টি ধাপে যাচাই করা হয় :
❖ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি (AI)
স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেম অনেক ভুল কনটেন্ট শনাক্ত করতে পারে।
❖ মানুষের যাচাই (মানব রিভিউয়ার)
বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত একটি দল কনটেন্টগুলো পর্যালোচনা করে।
❖ কমিউনিটির রিপোর্ট আমরা সবাই চাইলে অনুপযুক্ত কনটেন্ট রিপোর্ট করতে পারি।
❖ যদি কোনো কনটেন্ট নিয়ম ভঙ্গ করে বলে প্রমাণিত হয়- তবে সেটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
কখনো কখনো ফেসবুক ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়।
পরিশেষে : যারা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন তাদের দায়িত্ব আরও বেশি।
যে কোনো কনটেন্ট প্রকাশের আগে ভাবুন- এটি কি ফেসবুকের নিয়ম অনুযায়ী নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য?
✅ যদি না হয়, রিপোর্ট করুন
✅ দায়িত্বশীলতা বজায় রাখুন
একটি সুস্থ ও নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ গঠনে আমরাই পারি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে।
মন্তব্য করুন