যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির এশীয় মিত্রদের কাছে যেন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম উত্তর কোরিয়া। ক্ষ্যাপাটে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়কের ক্ষেপণাস্ত্রবিলাস ও পরমাণু অস্ত্রের কারণে প্রতিমুহূর্তে হুমকির মুখে থাকে কোরীয় ও এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা। দেশটির জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকে সামরিক খাতে। এমন অবস্থায় বিশ্বরাজনীতিতে আলোচনার অন্যতম বিষয় থাকে দেশটির পরমাণু অস্ত্রকেন্দ্রিক তৎপরতা। আর নিয়ন্ত্রণহীন এই তৎপরতাই বিশ্বের মাথাব্যথার বড় কারণ।
উত্তর কোরিয়ার কাছে ঠিক কতটি পরমাণু অস্ত্র আছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত ছয়বার পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে পিয়ংইয়ং। সবাইকে হতবাক করে দিয়ে ২০০৬ সালের ৯ অক্টোবর প্রথমবারের মতো পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালায় বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ উত্তর কোরিয়া। তখন দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন কিম জং ইল। তারপর তার ছেলে বর্তমান শাসক কিম জং উনের সময়ে সবশেষ ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়। পরমাণু অস্ত্র বিশ্লেষকদের মতে, দেশটির হাতে অন্তত ৪০টি পরমাণু অস্ত্র আছে বলে ধারণা।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের জন্য উত্তর কোরিয়ার কাছে পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম রয়েছে, যা বোমা তৈরির মূল উপাদান ফিসাল তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৬০টি পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাল উপাদান রয়েছে পিয়ংইয়ংয়ের কাছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতিবছর আরও ১২টি পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাল তৈরি করছে দেশটি। ফলে বর্তমানে ১০০টির বেশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রয়েছে পিয়ংইয়ংয়ের কাছে। ২০২৭ সালের মধ্যে দেশটির কাছে অন্তত ২০০টি পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল মজুত থাকবে বলেও ধারণা।
প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সামরিক জনবল রয়েছে উত্তর কোরিয়ার। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্যানুসারে, উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০ লাখ ২৮ হাজার। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাসদস্য ৬ লাখের মতো। দেশটির রিজার্ভ সেনার সংখ্যা ৬ লাখের মতো। সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৬ হাজার ৪৫টি ট্যাঙ্ক, ১৩ হাজার আর্টিলারি গান ও সাড়ে ৫ হাজার রকেট লঞ্চার। দেশটির বিমানবাহিনীতে যুদ্ধবিমান রয়েছে ৫৫০টি ও হেলিকপ্টার ২ হাজার ৯০৪টি। নৌবাহিনীতে মোট রণতরীর সংখ্যা ৯৮৪। এর মধ্যে ১১টি ফ্রিগেট, ৮৩টি সাবমেরিন ও ৪১৬টি টহল রণতরী।
উত্তর কোরিয়ার আধা সামরিক (প্যারামিলিটারি) বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ৫৮ লাখ ৫৯ হাজার। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্যারামিলিটারি রয়েছে উত্তর কোরিয়ায়। ওয়ার্কার-পিজেন্ট রেড গার্ড নামে ডাকা হয় দেশটির এই বাহিনীকে। বলা হয়, উত্তর কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগই প্যারামিলিটারি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর উত্তর কোরিয়া ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের সামরিক বাজেট ব্যয় করে, যা দেশটির মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশ। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, উত্তর কোরিয়ার অধিকাংশ সমরাস্ত্রই পুরোনো প্রযুক্তির। তবুও দেশটির বর্তমান সামরিক সক্ষমতা দক্ষিণ কোরিয়াকে তছনছ করে দিতে যথেষ্ট।
নিজেদের সাইবার সক্ষমতা বাড়াতেও যথেষ্ট ভালো বিনিয়োগ করছে উত্তর কোরিয়া। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে সাইবার হামলার জন্য দেশটি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা চীনের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের অভ্যন্তরেই প্রশিক্ষণ নেয়। এরই মধ্যে দেশটির হ্যাকাররা দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক অবকাঠামো ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করার সক্ষমতা দেখিয়েছে।
মন্তব্য করুন