গুজরাটের আর দশটা সকালের মতোই এক স্বাভাবিক সকাল। মানুষ তখন কাজের পথে, কেউ ঘরে ফিরছে ক্লান্ত শরীরে আবার কেউ পরিবার নিয়ে রওনা দিয়েছে কাছের শহরের দিকে। কিন্তু সেদিন অনেকের জীবন থেমে গেল এক হৃদয়বিদারক মুহূর্তে। একটি পুরোনো সেতু আচমকা ভেঙে পড়ল মহিসাগর নদীর বুকে। কমপক্ষে ১৫ জনের প্রাণহানি, অনেকেই এখনো নিখোঁজ, আর যারা বেঁচে আছেন, তারা এখনো সেই ভয়ংকর মুহূর্ত ভুলতে পারছেন না।
৪০ বছরের পুরোনো সেতুটি গুজরাটের ভদোদরা জেলার সঙ্গে মধ্য গুজরাটকে যুক্ত করত এবং প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করত। বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নদীতে সেতু ভেঙে পড়া নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
একটা শব্দ আর সবকিছু অন্ধকার
আনোয়ার ভাই নামের এক ব্যক্তি একটি ভ্যানে দুই যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তারা সেতুর মাঝখানে। হঠাৎ পেছন থেকে এক বিস্ফোরণের মতো শব্দ। মুহূর্তেই সবকিছু যেন থমকে গেল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পেছনে সেতুর অংশটা হঠাৎ ভেঙে পড়ে গেল। একটা শব্দ, আর তারপর দেখি গাড়িগুলো নদীর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভ্যানটাও গড়াতে শুরু করেছিল... আমি জানি না কীভাবে আমরা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। এক সেকেন্ড দেরি হয়তো হলে আমরাও আজ বেঁচে থাকতাম না।’
এক মায়ের আর্তনাদ
পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য সোনালবেন পাধিয়া। দুর্ঘটনায় তিনি তার ছয়জন আত্মীয়কে হারান। গাড়িতে তার ছেলেসন্তানও ছিল সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি পেছনের সিটে বসা ছিলেন। হঠাৎ গাড়িটি পানিতে পড়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘আমি চিৎকার করতে থাকি, আমার ছেলেকে বাঁচান!’ অনেকক্ষণ পর কেউ এসে আমাকে টেনে তোলেন।
ঘণ্টাখানেক পর তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয় ঠিকই। কিন্তু তার ছয়জন প্রিয়জন, তারা আর কেউই ফিরে আসেননি। সোনালবেনের আকুতি ভরা একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা দেখে কেঁদেছে হাজারও মানুষ।
মৃত্যু আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল, বেঁচে ফিরেও কাঁপছেন অনেকে
দিলিপসিংহ পাধিয়া বাইকে চড়ে ফিরছিলেন কাজ শেষে। তিনি জানান, মাত্র ১০০ মিটার পেরিয়েছি, হঠাৎ দেখি সেতু কাঁপছে। একসময় আমার বাইকসহ আমি নদীরতে পড়ে যাই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশে শুধু পানি আর মানুষের আর্তনাদ। কোনোমতে একটি রড ধরে ভেসে থেকে বেঁচে যান তিনি। স্থানীয় জেলেরা এসে তাকে টেনে তোলে।
যখন বিপদ আসে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা দড়ি হাতে ছুটে আসেন, নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। জয়রাজ সিংহ, যিনি দুর্ঘটনার খবর পেয়েই ছুটে যান, বলেন, ‘এমন দৃশ্য জীবনে কখনও দেখিনি। মানুষ সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, গাড়িগুলো ভেসে যাচ্ছে। আমরা দড়ি বেঁধে গাড়িগুলো টানতে থাকি। অনেকে কাঁদছিল। কেউ কাউকে চিনত না, কিন্তু সবাই চেষ্টা করছিল অন্যের জীবন বাঁচানোর।’
স্থানীয়রা জানান, বহু বছর ধরেই সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ। আভেসিংহ পরমার, পাশের গ্রামের পঞ্চায়েতপ্রধান, বলেন, ‘আমরা অনেকবার অভিযোগ করেছি। রড বেরিয়ে ছিল, গর্ত ছিল। আমরা সবাই ভয় পেতাম এই সেতু পার হতে। কিন্তু কেউ আমাদের কথা শুনল না।’
তবে গুজরাট সরকারের মুখপাত্র ঋষিকেশ পটেল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘সেতুটি নিয়মিত পরীক্ষা ও মেরামতের আওতায় ছিল। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি পুরনো সেতু ভেঙে নতুন করার অনুমোদনও দিয়েছেন।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণেরও ঘোষণা দিয়েছেন। গুজরাট সরকারের তরফে বলা হয়েছে, নতুন সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু তার আগেই থেমে গেল বহু জীবন।
এই সেতু ধস ভারতের বহু পুরোনো ও অবহেলিত অবকাঠামো সমস্যার আরেকটি মর্মান্তিক উদাহরণ। এর আগে ২০২২ সালে গুজরাটের মোরবিতে ১৩৭ বছরের পুরোনো একটি সেতু ধসে ১৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
মন্তব্য করুন