কালবেলা ডেস্ক
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৫, ০৮:৩৮ পিএম
আপডেট : ২১ জুন ২০২৫, ১১:৫৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধ

ইরানই হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্যের চাবিকাঠি

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

গত কয়েক মাস ধরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে করণীয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়েও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানুয়ারিতে জানিয়েছে- তারা ১ জুলাই থেকে ইরানি তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করবে।

যদিও পরে নতুন করে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও ইরানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তবু পুরো পরিস্থিতিতে অস্থিরতার ঘনঘটা রয়ে গেছে।

তবে আশঙ্কার চেয়ে সম্ভাবনা বড়। বহু পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে সেটিই হবে সবচেয়ে ভয়ানক পরিণতি। কিন্তু বাস্তবতা হতে পারে ঠিক উল্টো- পারমাণবিক ইরানই মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারে।

ইরান সংকট ৩টি সম্ভাব্য পথে এগোতে পারে। প্রথমত, কূটনৈতিক চাপ ও নিষেধাজ্ঞা যদি সফল হয়, তবে ইরান হয়তো পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করতে পারে। তবে ইতিহাস বলছে, যেসব দেশ এই পথে এগিয়েছে, তারা সহজে পিছু হটে না। যেমন উত্তর কোরিয়া, নিষেধাজ্ঞার পরও পারমাণবিক শক্তিধর হয়েছে। ইরান যদি মনে করে অস্ত্র তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি, তবে নিষেধাজ্ঞা উল্টো তাদের আরও প্রতিরোধী করে তুলবে।

দ্বিতীয় পথ হলো ‘ব্রেকআউট সক্ষমতা’ অর্জন- অর্থাৎ তারা সরাসরি বোমা তৈরি না করেও এমন অবস্থানে পৌঁছাবে, যেখানে খুব কম সময়েই অস্ত্র বানানো সম্ভব। জাপান এর উদাহরণ, যার শক্তিশালী পরমাণু অবকাঠামো থাকলেও তারা এখনো বোমা বানায়নি।

ইরানও এই পথ নিতে পারে। এতে তারা অভ্যন্তরীণ চাপে কিছুটা স্বস্তি পাবে এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ধাক্কা এড়াতে পারবে। তবে এই কৌশল সব সময় সফল নাও হতে পারে- বিশেষত ইসরায়েলের জন্য, যারা এমন সক্ষমতাকেও হুমকি মনে করে এবং যেকোনো সময় নাশকতা বা হামলার পথ নিতে পারে।

তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হলো- ইরান সরাসরি পারমাণবিক পরীক্ষা করে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এমন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ মনে করলেও ইতিহাস বলছে, নতুন পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোকেই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়। বরং অনেক সময় এতে ভারসাম্য তৈরি হয় এবং সংঘাত কমে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচেটিয়া পারমাণবিক আধিপত্য চার দশক ধরে চলেছে। এটি-ই এ অঞ্চলের বড় অস্থিতিশীলতার উৎস। যদি ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি হয়, তবে সেটিই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে। ইরাক ও সিরিয়ায় ইসরায়েল যেভাবে হামলা চালিয়েছিল, ইরানের বেলায়ও তেমন পদক্ষেপ নিতে পারে তারা। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয় এবং ইসরায়েলের প্রতিপক্ষদের প্রতিরোধ তৈরির প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।

এতসব উত্তেজনার মধ্যেও ইরানকে ‘অযৌক্তিক’ বা ‘উন্মাদ’ হিসেবে দেখার প্রবণতা অনেক বিশ্লেষকের মধ্যে আছে। কিন্তু বাস্তবে ইরানি নেতৃত্ব বরং অনেক বেশি বাস্তববাদী ও টিকে থাকার কৌশলে বিশ্বাসী। তারা চড়াও বক্তব্য দিলেও, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় না- যা ২০১২ সালে হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করার মধ্যেই স্পষ্ট।

বলা হয়, পারমাণবিক অস্ত্র পেলে ইরান আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে কিংবা অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো বরং আরও সতর্ক হয়ে পড়ে- চীন, ভারত বা পাকিস্তানের মতো। আর পারমাণবিক প্রযুক্তির নজরদারি এত উন্নত যে, অস্ত্র পাচার করলে ধরা পড়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার আশঙ্কাও বাস্তবসম্মত নয়।

আরেকটি সাধারণ আশঙ্কা হলো, ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হলে অন্য মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই বিস্তার নিয়ন্ত্রিতই থেকেছে। ১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার পরও এই অঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার হয়নি।

ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ বলছে, পারমাণবিক ভারসাম্য যুদ্ধ নয়, বরং স্থিতিশীলতা বয়ে আনে। এই বাস্তবতা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যেও প্রযোজ্য হতে পারে। যদি ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হয়, তাহলে তার অস্তিত্বকে মেনে নিতে বাধ্য হবে বাকিরা, এবং পারস্পরিক প্রতিরোধের মাধ্যমে একটি নিরাপত্তাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হতে পারে।

সুতরাং, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে বেপরোয়া পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার নেই। বরং নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে সংলাপ অব্যাহত রাখা উচিত। কারণ, খোলামেলা যোগাযোগ ও কূটনৈতিক বোঝাপড়া একটি পারমাণবিক ইরানের সঙ্গে সহাবস্থানকে সহজ করবে।

সবশেষে, ইতিহাস বলছে- যেখানে পারমাণবিক শক্তি এসেছে, সেখানেই এসেছে ভারসাম্য। অস্ত্র যতই ভয়ংকর হোক, সেগুলোর উপস্থিতিই অনেক সময় সংঘাত ঠেকানোর প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যও এর ব্যতিক্রম হবে না। এজন্যই বলা যায়, পারমাণবিক ইরানই হতে পারে এই অঞ্চলে টেকসই শান্তির মূল চাবিকাঠি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বাস্থ্যসেবায় নার্সদের ভূমিকা দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে : অতিরিক্ত সচিব সালাম

উল্টে যাওয়া ইঞ্জিন উদ্ধারে গিয়ে লাইনচ্যুত হলো রিলিফ ট্রেন

জকসু বিষয়ে সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক

জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছেলে-মেয়েরা জীবন দেয়নি : সারজিস

মেসিকে না খেলানোর ব্যাখ্যা দিলেন স্কালোনি

এনপিবি নিউজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা শুরু

বাবা হারালেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা প্রিন্স

সেই মেজর জেনারেল কবিরের বিষয়ে যে তথ্য দিল সেনাসদর

আবাসিক হোটেলে প্রেমিকাকে ধর্ষণে মৃত্যু, গ্রেপ্তার ২

১০

মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার দাবি জাকসুর

১১

আবুধাবিতে বাংলাদেশের বোলিং তোপে চাপে আফগানিস্তান

১২

বিএনপি সরকারে এলে জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করবে : শামা ওবায়েদ

১৩

সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক মিসাইল উন্মোচন করল উত্তর কোরিয়া

১৪

বাগদান সারলেন তানজীব সারোয়ার

১৫

ইলিশ শিকারে গিয়ে জেলেদের সংঘর্ষ, জেলের মরদেহ উদ্ধার

১৬

নির্বাচনে কত সেনা মোতায়েন থাকবে, জানালেন মেজর হাকিমুজ্জামান

১৭

শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতার দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ

১৮

বিতর্কে জড়ালেন অনীত পাড্ডা

১৯

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান পেছাল 

২০
X